"আর খেতে পারবো না; অনেক দেরি হয়ে গেছে!", বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উঠে পড়লো অঙ্কুর।
"রোজ রোজ ভাত নষ্ট করছিস বাবু! রাতে শুবি দেরি করে, আর আমার ওপর চোটপাট যত," ছেলের প্রতি অভিমান জানিয়ে দিলেন মা; কিন্তু অঙ্কুরের সেই দিকে খরচ করার মতো সময় নেই তখন। মায়ের আঁচলে মুখটা মুছে, একবার জড়িয়ে ধরে দ্রুত ব্যাগটা তুলে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
৮:৪৩। উফ্ ... আজ বোধয় মিস-ই হয়ে গেল... সকাল ৯টায় ক্লাস; এখন সবে এন্টালি। মল্লিক বাজারে নেমে কলেজ অবধি ঢুকতেই তো আরও দশ মিনিট লাগবে। এর মধ্যে যদি বাস-টা মিস হয়ে গিয়েই থাকে, তাহলে আর ক্লাস করাও যা, না করাও তা। একবার বাস-স্টপ থেকে ডান দিকে তাকাতেই দেখা গেল ২২৩ আসছে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন দুরু দুরু করে উঠলো অঙ্কুরের।
ভিড় বাস। কিন্তু চোখ যদি ভিড় না খোঁজে, তাহলে আর ভিড় কই! স্যাঁট করে বাসে উঠে পড়লো অঙ্কুর সামনের দরজা দিয়ে। উঠেই দেখলো ডান দিকে। নেই...নেই...নেই...ওই তো ! বাসের সামনের দিকে মুখ করা প্রথম সিটেই বসে আছে জয়ীতা; আর আজও ঘুমাচ্ছে! সুদীর্ঘ নিঃস্বাস স্থান পেলো অসংখ্য প্রস্বাসের মাঝে।
মল্লিক বাজার আসার ঠিক আগেই অঙ্কুর বাসের ভেতরের দিকে ঢুকে জয়ীতার দিকে হাত বাড়িয়ে ওর ব্যাগ ধরে দুবার জোরে টানতেই জয়ীতা হকচকিয়ে উঠে পড়লো; আর কিছু বোঝার আগেই চোখ পড়লো এক গাল হাসিতে ভরা অঙ্কুরের মুখে।
"নামতে হবে রে, চল!"
একটা ছোট্ট হাসিতে চুড়ান্ত লজ্জা লুকোনোর বৃথা চেষ্টা করতে করতেই জয়ীতা উঠে পড়লো; দুজন নামলো বাস থেকে।
"এবার বড্ডো embarrassing হয়ে যাচ্ছে। রোজ রোজ অমানুষের মতো ঘুমোচ্ছি বাসে আর তুই দেখছিস!"
৮:৫৮। দুজন ছুটছে কলেজের দিকে এখন।
"তোর পাশের মহিলার reaction-টা তো দেখলি না! এতটাই shocked হয়েছিলেন আমার কান্ড দেখে, বুঝেই পাচ্ছিলেন না চেঁচাবেন না হা করে দেখবেন কি করছে ঠিক ছেলে টা।" ছুটতে ছুটতেই হো হো করে হাসছিলো অঙ্কুর।
জয়ীতা কোন উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি সেদিন, শুধু ঠোঁটে আগের ঘুমন্ত দিনের মতোই আলগা হাসি লেগেছিলো।
****************************************************
"এই অঙ্কুরদা, আমি manuscript-টা পাঠিয়ে দিয়েছি কিন্তু email-এ; তুমি please lunch-এর আগে দেখে আমায় comments পাঠিয়ে দিও।"
সৌরভের ডাকে ঘোর কেটে গেল অঙ্কুরের। "Thanks রে, পাঠাচ্ছি; এমনিও তেমন কিছু correction-তো ছিল না। "
"না না, ওই just নতুন plot-টা ঢুকিয়ে দিয়েছি, আর Introduction আর Conclusion গুলো mildly বদলেছি। "
অঙ্কুর মাথা নাড়লো; Introduction আর Conclusion! সেই; আজ জয়ীতার বিয়ে, নেমন্ত্রন আছে। কলেজের তিন বছর বাদে আর কথা হয়নি জয়ীতার সাথে; মাস ছয় আগে একটা বড় email করে জয়ীতা বিয়ের নেমন্ত্রন জানালো অঙ্কুরকে। সেখানে লেখা ছিল, "বিয়েটা করেই নিচ্ছি।" তারপর একবার ফোনে আমন্ত্রণ। অঙ্কুরের না যাওয়ার তো কোন কারণ ছিল না জয়ীতার বিয়েতে। কেনই বা থাকবে? অঙ্কুরতো কোনোদিন জানায়নি ওর ভালোবাসার কথা। তাই গিয়ে উপহার দিয়ে পুরোনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে খেয়ে চলে এলেই হলো! এখন সে কলকাতার এক নাম-জাদা পদার্থ বিদ্যার ইনস্টিটিউটের faculty member ; রেলা নিয়ে যাবে, খাবে, বেরোবে, আর অন্ধকার রাস্তায় আর বাড়ির ব্যালকনিতে চোখের জল ফেলবে; ব্যাস, আবার কি? থাক, সৌরভের manuscript-টা দেখে ফেলা যাক, ব্রাইট ছাত্র - অনেকটা নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় ওর মধ্যে অঙ্কুর।
********************************************************************
"কি রে, যাবি না বিয়েতে?" বাবা জিজ্ঞেস করলেন অঙ্কুরকে।
"হ্যাঁ, এই তো ready হচ্ছি। "
"সাতটা বাজে, এখন ready হবি আর পৌঁছাবি কি রাত ১০টায়?"
"আরে না না, তাহলে আর খাবার থাকবে না। "
"হ্যাঁ, সেটা তো আমি জানি। ব্যাপারটা কি? কান্না পাচ্ছে?"
"উফ্ বাবা, এখন না! তোমার সব সময় এই attitude আমার ভালো লাগে না। দেখি, ready হতে দাও। "
"চল আমিও যাই তোর সাথে; আর তোর মাকেও বলি ready হতে, এমনিও তোর থেকে কম সময় নেয় তোর মা। "
"মানে! মানে টা কি? ইয়ার্কি মেরো না তো, দেরি হয়ে যাচ্ছে!"
"ইয়ার্কি কেন মারবো? দেখতে চাই বাপের ব্যাটা কতটা বাপের মতো হয়েছে। না দেখলে তো বুঝবো না তোর বউ-এর কতটা দরকার তোর মায়ের মতো হওয়ার। "
"এই যাও তো এখান থেকে। "
"আরে নে নে , পাঞ্জাবিটা পড়ে নে। এই শুনছো, তোমার ছেলে একদমই তোমার আর আমার দোষগুলোই পেয়েছে। আমিই এতদিন ভাবতাম উল্টোটা। "
অঙ্কুর বাবাকে ignore করে পাঞ্জাবি পড়তে থাকলো। এই সময় মা ঘরে ঢুকে এলেন।
"কেন বিরক্ত করছো ওকে এখন? এমনিই দেরি করেছে এতো। "
বাবা মাকে বললেন, "আরে এসো এসো, তোমার খোকা যাচ্ছে দেবদাস হতে - দেখবে না ?"
অঙ্কুর এবার হেসে ফেললো, "তোমার হয়েছে জ্ঞান দেওয়া?"
বাবা বললেন, "শোন ব্যাটা, তোর মা-কে চেনার আগে আমি বেশ কিছুবার হাবু-ডুবু খেয়েছি। এই তোর-ই মতন আমি নিজেকে দেবদাস বানিয়েছিলাম একবার। সে কি আনন্দ কি বলি, মানে তুই আরেকটু হলেই সেটা বুঝতে পারতি; কিন্তু বাবা হয়ে তো আর ছেলেকে নেশাগ্রস্থ হতে দিচ্ছি না। যাই হোক; আমি একজনকে কলেজে কিছুই বলে উঠিনি; তারপর farewell-এর দিন ধপ করে প্রেমে পরে গেছি। আসলে পড়তাম না। সব program শেষ হওয়ার পর বেরোনোর সময় সেই দিদিমনি আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে নিছক balance হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিলো আর আমি তাকে সেই পড়ে যাওয়া থেকে আটকেছিলাম। সে নিজেকে সামলাতে আমার হাত-টা ধরেছিলো - আর আমিই পুরো বেসামাল হয়ে গেলাম! কেউ মাতাল হতে চাইলে কি আর মদের প্রয়োজন হয়? নিজেই প্যামফ্লেট ওড়ালাম নিজের উপন্যাসের। মানুষ লুফে নিলো! আমায় পায় কে তখন! প্রেমের থেকে অনেক বড় নেশা হলো নিজেকে প্রেমিক ভাবা।
এরপর তোর মা এলো জীবনে। সেই প্রেম কাহিনী শুনেই তো ছোটবেলায় ঘুমাতি যেতি। নতুন করে কি আবার শুনবি? চোখ খুলে ঘুমাতে চাইলে আমি শুনিয়ে দিচ্ছি আবার। "
মা বললেন, "সাড়ে ৭টা বেজে গেল। তোর বাবার কথা শুনবি না বিয়ে বাড়ি যাবি ?"
"দুটোই করবে। আমাদের ছেলে; কি রে?", বাবা চোখ তুলে তাকালেন অঙ্কুরের দিকে।
অঙ্কুর মা,বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর মা অঙ্কুরের চোখের জল আলতো করে মুছে দিতে দিতে বললেন, "তোর বাবা কিন্তু আমায় ছাড়া অন্য কাউকে এতো ভালোবাসতে পারতো না। "
বাবা বললেন, "এই নে, তোর Uber is arriving in 4 minutes . চল বেরো।"
***************************************************************
"বাবু ঠিক থাকবে তো, বলো ?"
"না। ঠিকের থেকে অনেক বেশি ভালো থাকবে। ঠিক থাকা বা না থাকা একটা choice . He's a smart boy "
******************************************************************
"তুই এতক্ষনে এলি? Last batch বসতে চলেছে; আমি ভাবলাম আসবি না।" জয়ীতা অভিযোগের সুরে বললো। "যাক ভালোই হলো, আমাদের সাথেই খেতে বসবি।"
"তুই বিয়ের মাঝে আমায় নিয়ে ভাবছিলি?"
কথাটা শুনে একটু থতমত হয়ে গেল জয়ীতা। তারপরই সেই বাসের ঘুম ভাঙা হাসিটা ঠোঁটে ফেরত এলো।
হাসলো অঙ্কুরও। বিয়ের present-টা জয়ীতার হাতে তুলে দিয়ে বললো, "ভালো থাকিস।"