Tuesday, May 21, 2019

যথাস্থান

যে রাস্তার ওপর বর্তমানের সাইকেল চলছিল, তা অনেকদিন মেরামত হয়নি। কোথাও গুঁড়ো গুঁড়ো রঙিন ইতিহাস , কোথাও আগামীর ভেঙে পড়ার সংকল্প এড়িয়েই অনুপ অতি ব্যস্ততার সাথে একটু দ্রুত বেগেই সাইকেলটি ছোটাচ্ছিলো। আজ দেরি হয়ে গেছে। হতচ্ছাড়া কেলুয়া দুপুরে মোষের মতো ঘুমাবে আর বেচারা অনুপকে দিদিমনির ধমক সইতে হবে। এই ভাবতে গিয়েই নিজের অভ্যেসে পাঞ্জাবির পকেটের ওপর একবার হাত বুলিয়ে সে দেখে নিলো তার হার্মোনিকাটি সেখানে আছে কিনা। যা অসাধারণ রাস্তা, বিশ্বাস নেই কখন অতি বিস্বস্ত হার্মোনিকাটিও তাকে ছেড়ে রাস্তার ধুলো মাখতে ব্যগ্র হয়ে ওঠে। কথাটি ভাবতেই মনের ভেতরটা খাঁ -খাঁ করে উঠলো। কি হয়েছে তার? এতো ভয় কিসের? আর বেশি কিছু না ভেবে সে সাইকেলের গতি আরও কিছুটা বাড়িয়ে দিলো।
যা ভেবেছিলো, ঠিক তাই। রাতুল, সুবীর, কানু, হারান সবাই পৌঁছে গেছে তার আগেই। ভেতর থেকে বিকট একটা সুর ছুটে আসছে, যেন নিজের স্রষ্টার থেকে কত তাড়াতাড়ি দূরে পালানো যায়। সাইকেলে তালা লাগাতে লাগাতে অনুপের বুঝতে বাকি থাকলো না হারান মনে প্রাণে ফুঁ দেওয়ার চেষ্টা করছে। হাসি মুখেই অনুপ কমলা দিদিমনির ক্লাসরুমে ঢুকলো। তাকে দেখেই দিদিমনি কড়া ভঙ্গিতে বললেন, "তোমার বোধয় ইদানিং বড্ডো কাজের চাপ বেড়েছে। " যা ভাবনা তাই! রোজ রোজ তো আর বলাও যায় না কেলুয়া দুপুরে পড়ে পড়ে ঘুমায় বরাদ্দ সময়ের ওপরে, তাই অনুপকেই কেলুয়ার ইস্তিরি গুলো এগিয়ে রাখতে হয়। সে কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো।  কমলা বললেন, "হোমওয়ার্কটা করা হয়েছে?" মাথা নেড়ে জবাব দিলো অনুপ। কমলা বললেন, "কই শুনি তবে। "

 বাড়ি ফিরতে একদমই ইচ্ছে করলো না আজ অনুপের। কোথায় যেন একটা অশান্তি অনুভব করছে আজ বিকেল থেকে। প্রাকটিস করা গান গুলো একটাও আজ সুরে রাখতে পারেনি সে।  এদিকে অহংকারের চোটে হারানকে দুটো কথাও শুনিয়ে দিয়েছে সে হেসে ফেলেছিলো বলে। নাঃ! দুর্বলের ওপর চোটপাট করা এতো সহজ কেন? অন্যরাও তো হাসছিলো, মুখ টিপে। কই, তাদের তো সে একটা কথাও শোনালো না! মনটা এমনিই খারাপ ছিল, এখন একদম তলানিতে এসে ঠেকলো। সোনাঝুরির সন্ধ্যে সাতটার অন্ধকারে এসে অনুপ উপস্থিত হলো। জ্বালাতন। গুচ্ছের গাঁজারি চারিদিকে। ওদিকে আবার আধ-ফালি চাঁদও উঠে বসে আছে। যখন অন্ধকার চাই, তখনি যেন আলোর খ্যামটা নাচের শখ হয়।  অন্য সময় তার ঘুমই ভাঙতে চায় না! অনুপ একটু হতাশা নিয়েই যথাস্থানে এসে পৌঁছলো।

সাইকেলে যেমনি তালাটা দিয়েছে, অমনি দেখে সামনে এসে সে উপস্থিত। এই মানুষটাকে অনুপ কিছুতেই বুঝে ওঠে না। সে সোজা সামনের লোকটার কাছে পৌঁছে বললো,

"এই যে দাদু, আজ এতো আলোর মধ্যে চলে এলে যে!"
দাদু ভুঁরু কুঁচকে একবার অনুপকে দেখে বললো, "এতো আলো দেখছেন মহারাজ! ভেতরের অন্ধকারটা দেখেও দেখছিস না। তোর যে সাজ আমার চোখে পড়ছে!"
" মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে, বুঝলে ?"
"খারাপ হয়ে নেই। দুর্বল হয়ে আছে। অবল হলে তাও বল প্রার্থনা করতাম তোর জন্য।"
"তোমার গান গুলো সব বেসুরে বাজিয়েছি আজ। "
"সে তো হবেই।  না মন সুরে ছিল, না সুর মনে। "
"দ্যাখো চেষ্টা তো করছি, কিন্তু মাথায় শুধুই ঝিলিক ঘুরে যাচ্ছে। "
"উঃ, নেকু খোকা! মন না পাগল গরু?"
"নিজেই তো বারণ মানে না বলেছো! এখন আমি কি করি?"
"প্রথমত আমার 'নিশীথ রাতের বাদল ধারা' শোনা বন্ধ কর। "
"একি, কেন? ওটা শুনলে তো তোমায় মনে পড়ে। "
"যত জ্বালা হয়েছে আমার, বুঝলি? আমি তো এখানেই থাকি। আমায় ভেবে ওই গান শুনিস, এসব আমায় বোঝাতে আসিস না। "
"কেন প্রেমে পড়লাম বলো তো?"
"প্রেমে পড়েছিস তো কি হয়েছে? রক্তকরবীও তো পড়েছিস। "
"এই যে এক লাইনে সব বলে দিলে, এবার কি ভাবে সব বোঝা যাবে?"
"হ্যা সেটাও ঠিক। তুই তো সবই বুঝিস। তবে অন্যেরাও সব বোঝে। আমার কথা শোনার কারোর সময় কই আজ?"
"আমি তো শুনি। "
"তুই মূর্খ বলে। তোর মতো কিছু মূর্খরা আমায় নিয়েই দিন রাত পরে আছিস।  হ্যাঁ রে, জয় করেও তোর এতো ভয় কিসের বল তো?"
"ওমা, জয় করলাম মানে? সে তো পাত্তাও দেয় না।"
"আবার বাজে কথা?"
"আচ্ছা বেশ, পাত্তা দেয়। কিন্তু বুঝতেই তো পারছো কি বলতে চাইছি। "
"সে তো আমি বললামই। গোল গোল ঘুরে যাবি কোথায় আমার কথার বাইরে? আমায় লাঠি না করে খুঁটি করতে তোরা এতো ব্যস্ত কেন বলতো?"
"দাঁড়াও দাঁড়াও। রক্তকরবীর ব্যাপারটা এরম হাওয়ায় ছেড়ে দিলেই হবে নাকি?"
"ফাগুন তো না। আর রঞ্জন হওয়ার কোনো ইচ্ছেই তোর দেখি না। "
"আবার ওই রেফারেন্স দিচ্ছ! লোকজনকে পড়িয়েই ছাড়বে নাকি? পাব্লিসিটি করতে ভালোই উদগ্রীব তুমি। "
"বাজে কথা ছাড়। ভেবে বলতো, রঞ্জন ছাড়া সেই নাটকের কোন চরিত্র তোর আদৌ হওয়া বাকি আছে?"
"কোনোটাই নেই। কিন্তু এই চঞ্চলতা দূর করি কি করে সেটা বলো এবার।"
"সত্যর সাথে থাক। সত্য থাকতে তোর আর কি প্রয়োজন?"
"এটা কি হলো? এরম ট্রাম্প কার্ড খেলে নিজের ট্যালেন্ট শো-অফ করতেই হলো?"
"সত্যান্বেষীর কাছে আমার আর কি বলার থাকতে পারে এর পরে?"
"এটা ডবল-ডোস হয়ে গেলো না?"
"অনেক রাত হয়েছে, এবার আমায় ঘুমাতে হবে। আবার ভোর চারটের সময় রামকিঙ্কর একদম তোর মতো সমস্যা নিয়ে আসবে। টুক করে ঘুমিয়ে নি।  দাঁড়িটাও কাটতে হবে। দেখি উঠি এখন। "

"অদ্ভুত লোক। নিজে সব গুছিয়ে লিখলো সারা জীবন।  আর আমার বেলায় কায়দা করে লেখাটা মাঠে মেরে দেওয়ার চেষ্টা যত। "


No comments:

Post a Comment

Exodus

What is life but a series of exodi - A child's birth from a safe, nurturing womb A boy learning to walk by himself A young man yearning ...