Tuesday, January 21, 2020

চিঠি

সেগুন কাঠের বিছানার ওপর ১০ বছরের পুরাতন তোষক, খাটের থেকে ছ-হাত দূরে লম্বা একটি আয়না , যার ডান পাশে Onida কোম্পানির সাদা-কালো টি-ভি। সেই টি-ভি-র দিকে মাথা করে দু হাতের আসনে গল্পগুচ্ছ নিয়ে এক কুড়ি বয়সীও রমণী ঘুমের অপেক্ষায় এই ছুটির দুপুরে পা দোলাচ্ছে। পাশের ঘরে দাদা-বৌদি আর মা-বাবা নিজেদের গুচ্ছ গুচ্ছ গল্পে মশগুল। স্নেহা ঘুমের অজুহাত দিয়ে চলে আসার সময় বৌদি একবার মস্করা করে রাতের ঘুম কে কেড়ে নিয়েছে সে প্রশ্ন করেছিল বটে, কিন্তু সে নিয়ে আর বেশি কথা বাড়ায়নি কেউ। হাতে বই থাকলেও, স্নেহার মনে কোনও শব্দই দাগ কাটছিলো না এখন। ওর রাতের ঘুম কেড়ে নেবে এমন পুরুষের তো দেখা পেল না আপাততঃ। কত চিঠিই তো ট্রাঙ্কে বন্দি হয়ে থাকলো। কই, গল্পগুচ্ছের ভাঁজে কেউ তো নিজের জায়গা করে নিতে পারলো না। ধুর! সব ছেলেই এক। ভীতু। যত সাহস অন্য ছেলেদের ওপর দেখাতে পারে এরা। সৎসাহস দেখাতে হয় রমণীর সামনে। সেখানে সব কটা কচুবনের প্যালারাম। ওই শুভ্র-টাকে একটু আলাদা মনে হয়েছিল কদিন, কিন্তু তার সাহস তো ওই; মুহূর্তের পার্থ, তারপর সারথির আশায় ছলছল আঁখি। কলেজ শেষ হতে চললো, নাহ! কি দুর্ভাগ্য ! মনটা কেউ লুন্ঠন করার ক্ষমতাই দেখালো না।
বইটা পাশে রেখে চোখ বন্ধ করলো স্নেহা। উফ! বিরক্তিকর! মুখটাও পেয়েছে যেন শরদিন্দুর ছাঁচে গড়া। ঘুমাতেও দেবে না দেখছি! ভালোই ছিল ঝুমুরের প্রেমে পাগল দু বছর ধরে, হঠাৎ কথা বার্তা নেই ওকে এসে একটা চিঠি দিয়ে গেল! আর দিবি দে, অন্য ছেলেদের মতো পেট ফাটানো হাসির কবিতা দে! তা না।  দু বছরের জমে থাকা সমস্ত প্রেম, অভিমান, ব্যাথা, সন্তুষ্টি এক সাথে স্নেহার পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে এলো। হতচ্ছাড়া বেয়াদপ ছেলে একটা! কিন্তু স্নেহা জানে তার কি করণীয়। শেষের কবিতা সে পড়েছে। যে ছেলে যত ভালো কবিতা লেখে, সে ততবড় আহাম্মক! বাস্তব পৃথিবীতে পা রাখার ক্ষমতা নেই, কিন্তু তাও বলবে পৃথিবীর গায়ে পা লাগালে পৃথিবীর অপমান।
ঘুম আসবে না এভাবে। কি মুশকিল! আবার কেউ এই ঘরে এলে কথা বলতে হবে। চোখ বন্ধ করেই থাকা  ভালো, যতই আবছা দাঁড়ি বা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার বন্ধ চোখে বাসা বাঁধুক।
এভাবে আরও কিছুক্ষন নিজের সাথে ধস্তাধস্তি খেলার পর স্নেহা উঠে বসলো। নিচে নেমে ঘরের দরজা ভেজিয়ে পড়ার টেবিলের সামনে গিয়ে একবার ইতস্তত করলো। তারপর আর থাকতে না পেরে ব্যাগের বড় চেন-টা খুলে ইকোনমিক্সের খাতাটা সাহস করে বের করেই ফেললো। সেটা খুলতেই একটা চিঠি আবির্ভূত হলো বেলিয়াঘাটার এই ছোট্ট, অথচ ঝলমলে ঘরটার অভ্যন্তরে। ভয়ে ভয়েই স্নেহা সেটা হাতে তুলে নিয়ে পুনরায় তোষকের উপর নিজেকে এলিয়ে দিলো। তারপর একবার দরজার দিকে চোখটা বুলিয়ে চিঠিটা বই-এর ভেতর ঢুকিয়ে পড়তে শুরু করলো।

এখানে বলা ভালো, প্রেমিক তার প্রেমিকার উদ্দেশ্যে কি লিখবেন তা সকলের না জানলেও চলবে, হয়তো না জানাই উচিৎ! অথচ পাঠিকার যে হৃদয় এতক্ষন ব্যাকুল করা হলো, সেই হৃদয়ের প্রতি লেখকের কর্তব্য থেকেই যায়। কিন্তু এখানেও আরেক গভীর সমস্যা। লেখক তো লেখক নন। লেখক তো কবি। পাঠিকাও তো আর অন্য সব পাঠিকা নন। অতএব, কর্তব্য পালন করার মত ফর্মালিটির পাঠামো বুদ্ধিদীপ্ত লেখকের কাছে কাম্য নয়। জীবনের এরম দুঃসাহসীক পরিস্থিতি থেকে লেখকের আদৌ উদ্ধার রয়েছে কিনা তা পাঠিকা ভিন্ন আমাদের সকলের অজানা। পাঠিকার চোখে ভুল ঠিক মাপার ধৃষ্টতা লেখক করে। সেই চোখে কত-কেউ না হারিয়েছে, কত-কেউ আরও হারাবে। কিন্তু পাঠিকার দৃষ্টি নিজে তো হারিয়ে আছে লেখকের ছন্দ ভাঙা খেলা শেষ হওয়ার অপেক্ষায়। ওই, খেলা ভাঙার খেলা আর কি! কখন কবিতার উৎস ফুটে ওঠে, কখন কবিতা নিজেরই হাত কামড়ে খায়, সে সব নিয়ে ভাবার সময় এখন নেই। সোজা কথা সোজা ভাবে বললে, তুই আমার লেখা, সেই লেখার উৎস, সেই উৎসের শিরায় শিরায় বয়ে চলা শব্দের হাহাকার ও আত্মসমর্পণ। নতুন করে কিছুই বলার নেই যেমন, তেমনই প্রতি মুহূর্তে সেই মুহূর্ত নিয়েই তুই আমার জীবনের উপন্যাস। আচ্ছা, এই মহাবিশ্বে যত নক্ষত্র, যত তারা, নিভে যাওয়া, জ্বলে ওঠা, জ্বলা-নেভার আন্তরিক যত টুকরো টুকরো খেলা, আমার আর তোর মুহূর্ত, সেই সব মুহূর্তেরও মুহূর্ত, সংখ্যায় কি তাদের চেয়েও কিছুটা বেশি নয়? যদি না হয়, তাহলে চল না, মুহূর্ত বাড়িয়ে নি।

চিঠির এই অংশেই স্নেহার দৃষ্টি নিজেকে সোঁপে দিয়েছিলো কিছুক্ষন। পৌষের আঁচে নূতন পাটালি বেশিক্ষন শক্ত থাকতে চায় না। কিন্তু এ হলো রমণীর মন। এর স্বাদ যত নোন্তা, ততই যেন পাটালির স্বার্থকতা। একবার নাক বেঁকিয়ে বইটা বন্ধ করে স্নেহা নিজের ওপর চাদর টেনে নিলো।
সেই চাদরের ভেতরের ঘটনা পাঠিকার একান্ত আপন। 

No comments:

Post a Comment

Exodus

What is life but a series of exodi - A child's birth from a safe, nurturing womb A boy learning to walk by himself A young man yearning ...