রণজয় চ্যাটার্জী। বয়স একত্রিশ। রং তামাটে , চোখে রিম-হীন চশমা , গাল ভরা আবছা দাঁড়ি, যদিও গোঁফ ও থুতনির কাছে বেশ গাঢ়। হাতে খোলা আছে পি জি উডহাউসের "সামার লাইটনিং " কিন্তু ওর দৃষ্টি কাঁচের জানালা পেড়িয়ে চলে গেছে বহু দূরে, অন্যমনস্কতার কোন গভীর কক্ষ্যে। হঠাৎ-ই কোন সহযাত্রির ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে রনজয়ের চেতনা ফিরে এলো। AC কম্পার্টমেন্ট হওয়ায় লোকের সংখ্যা কম। চেয়ার-কার সিট। প্রায় পুরো কামরাই খালি।অনেক দিন কোনো নতুন গল্প লেখেনি রণজয়।মাথায় ছোট্ট ইডিয়া আসছিলো।কিন্তু সেটাও ভেঙে গেলো এখন। রণজয় ঘড়ি দেখলো একবার রাত ১১টা। উপকূল এক্সপ্রেস ছুটে চলেছে চেন্নাই-এর লক্ষ্যে। ট্রেন লেট করেনি আজ একদম-ই। আর পনেরো মিনিটেই জজপুর রোড স্টেশন আসবে। রণজয় কে নামতে হবে এখানেই। শুভদা বলেছে স্টেশনে গাড়ি থাকবে। সেই গাড়ি করে আরো ১২০ কিমি গেলে তবে কেওনঝর পৌঁছাবে। শুভদা আর রণজয় এক বছরের ছোট বড়। রনজয়ের পিসির ছেলে শুভদা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের এক নামজাদা নবরত্ন কোম্পানিতে চাকরি। বিয়ে করেছে বছর পাঁচ আগে। দু বছরের মেয়ে ঈশিতা, মায়ের সাথে কলকাতায় থাকে। শুভদার লাভ marriage . স্কুলের প্রেম। ঋতুপর্ণা ছিল শুভদার দু ব্যাচ সিনিয়র। রঞ্জয়ের মনে আছে যখন বাড়িতে এই সম্পর্ক মানতে নারাজ , তখন রণজয়-ই এই পরিণয়ের কান্ডারি হয়েছিল। বাসর ঘড়ে যখন বয়স নিয়ে বড়দি খোঁচা মেরেছিলো ঋতুপর্ণাকে , তখন -ই তো সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিল ঋতুপর্ণা , "I love falling for younger men". বড়দি আর একটা কথা-ও বলতে পারেনি উত্তরে।
সেই বিয়ের পাঁচ বছর হয়ে গেছে। সময় কিভাবে বয়ে চলে ; তার স্রোত শুরুতে টলটলে, কিন্তু শান্ত হলেই ঘোলাটে। নিজের জীবনের সম্পর্কগুলো ভেসে উঠলো রনজয়ের সামনে। তখনই ট্রেন-ও ঢুকলো জজপুর স্টেশনে। সাথে ছোট্ট একটা ব্যাগ শুধু রনজয়ের। আজ শুক্রবার , পর্শু ফিরে যাবে কলকাতায়। সোমবার অফিসে না গেলেই নয়। ব্যাগ পিঠে চাপিয়ে নেমে পড়লো ট্রেন থেকে। ছোট স্টেশন , এই মধ্যরাতে জন-শূন্য। রণজয় সোজা হেঁটে গেল স্টেশনের ভিতর। ফোনে কেবল হাত পড়েছে , ওমনি একজন বেঁটে মতো লোক এসে বললো , "আপনি রন বাবু আছেন কি?" রণজয় বললো , "হ্যাঁ , তুমি কি রাজকুমার ?" মাথা নেড়ে বেটে মানুষটা উত্তর দিল, "যি হাঁ। আমায় শুভ বাবু পাঠাইলেন। " আর প্রশ্নের প্রয়োজন বোধ না করে রণজয় বললো ," বেশ , চলো তাহলে। "
কম্পানি থেকে গাড়ি দেওয়া হয়েছে শুভদাকে। এমন জায়গায় নাকি ওর পোস্টিং , যেখানে আর কোনো যানবাহনের দেখা মেলে না। প্রথমে এরম একটা জায়গার কথা শুনে খুবই উত্তেজিত হয়েছিল রণজয়। জন বসতি থেকে বেশ খানিকটা দূরে , পাহাড়ী জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত একটা ড্যাম। এই ড্যামকে কেন্দ্র করে একটি বাংলো , আট-দশটা কোয়ার্টার আর কিছু মাটির ঘর। বাংলোটি বরাদ্দ ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ারের জন্য। শুভদা এসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার। ওর থাকার ব্যবস্থা একটি কোয়ার্টারে। নিজের রান্না নিজেকেই করতে হয়। ছোটবেলায় পড়া অজস্র গল্পের কথা মনে পড়েছিল রনজয়ের। তাই অনেকদিন ধরেই এখানে ওর আসার ইচ্ছে ছিল। কাজের চাপে এতদিন সময় হয়নি। হয়তো শুধুই কাজের চাপ না। কলকাতায় ইদানিং মন, পা দুটো-ই গেঁথে ছিল রনজয়ের। কিন্তু বারবার শুভদা ওকে আস্তে বলায় এবার ট্রেনের টিকিট কেটেই ফেললো। কিন্তু ট্রেনে বসেও যতই উত্তেজনা থাকুক না কেন , অন্ধকারে পাহাড়ী রাস্তায় চলতে চলতে একটু অস্বস্তি-ই হচ্ছিলো ওর।
"বাবু আপনার কথা খুব বোলেন ", দেহাতি ভাষায় বললো রাজকুমার। এই অন্ধকারে লোকটা কথা না বলে গাড়ি চালালে রণজয় খুশি হয়। রাজকুমার আবার বললো, "হামনে শুনা হ্যা আপনারা দোনো একসাথে স্কুলে যেতেন। "
ড্রাইভারের আয়নায় তাকিয়ে রণজয় হাসলো। ও বুঝলো শুভ কথা বলার লোক পায়না। "হ্যাঁ, ঠিক-ই শুনেছ," রণজয় বললো। রাজকুমার যেন উৎসাহ পেয়ে গেলো, "বৌদি ওউর বেটীমনি আয়েথে কুছ হপ্তা আগে। "
ঋতুপর্ণা আর ঈশিতা এসেছে তিনবার এখানে। কিন্তু এই জনমানবহীন জঙ্গল ঋতুপর্ণার পছন্দ হয়নি একেবারেই। শুভদা নিশ্চই র বেশীদিন এখানে থাকবে না। তাই তৎপর হয়ে রণজয় এসেছে এবার।
গাড়ি এবার পাহাড় পেড়িয়ে জঙ্গলে ঢুকলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার। রনজয়ের "অরণ্যের দিনরাত্রি" সিনেমার একটি দৃশ্য মাথায় এলো। এখন গা ছমছম করছে একটু। কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না। হেডলাইটের জন্য রাস্তার ধারের গাছ গুলো যতটুকু বোঝা যাচ্ছে। রাজকুমার যেন পারল রনজয়ের মনে কি চলছে , "দাদাবাবুর কি ডর লাগছে ?"
একটু বিরক্ত হয়ে রণজয় বললো, "কেন ভয় লাগার কি আছে ?" রাজকুমার হাসলো , "হামি বুঝি। আপনাদের শহরের লোকেদের এই রাস্তায় ডর লাগে। বাবু তো শাম কে বাদ নিকালতে হি নাহি !"
"ও! তোমার বাবু দেখছি খুব বীরপুরুষ। আমার ভয় তা একটু কম। আচ্ছা, একটা কথা বলো তো রাজকুমার। তোমার বাড়ি কোথায়? " রাজকুমার হেসে বললেন, " এই সওয়াল হামায় সবাই করে! হামার বাড়ি আছে পাকুড়ে। পাকুড় মালুম হ্যা বাবু?" রণজয় মাথা নেড়ে বললো, "হ্যাঁ, বাংলা-বিহার বর্ডার। রামপুরহাট আর ফারাক্কার মাঝে। তো তুমি এখানে ড্রাইভের হলে কি করে?" রাজকুমার আয়নায় চোখ রেখে বললো, "হাম কালকাত্তামে গাড়ি চালাতে থে। জিস বাবু কে লিয়ে চালাতে থে, উন্কা তাবাদলা হো গায়া ইহা। উনহনে বোলা কি হাম ভি উনাকে সাথ আয়ে , তানখা জ্যাদা মিলেগি। তবে সে হাম ড্যাম কে সাথ জুর গেয়ে। উও বাবু রিটায়ার হো গেয়ে পাড় হাম রেহে গেয়ে। "
ফোন বাজলো রনজয়ের। সেই নম্বর ! একটু বিরক্ত হয়ে রণজয় বললো "হুঁ বলো !" ওপারের কথা শুনে উত্তর দিলো, "তোমায় তো বলেছি কিছুদিন আমি break নিচ্ছি। সময় হলে আমি-ই নয় তোমায় কল করবো ! এখন রাখছি। " কেটে দিয়ে সুইচ অফ করে দিল।
হঠাৎ মেঘের গর্জন শোনা গেল। একটু আঁতকে উঠলো রণজয়। এই অরণ্যে আবার বৃষ্টি? উফ! তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারলে হয় এখন! "এদিকে কি বৃষ্টি হচ্ছে নাকি?" রণজয় জিজ্ঞেস করলো। "হাঁ বাবু। কুছ দিন সে বারিষ চল রাহি হে", রাজকুমার উত্তর দিল। "কিতনা দূর হে ইহাসে?" রণজয় উদ্বেগ চেপে রেখে জিজ্ঞেস করল। "অর কারিব বিস মিনিট," বললো রাজকুমার। রণজয় খেয়াল করল রাস্তায় কাদা বোঝা যাচ্ছে না। ও জিজ্ঞেস করল " শেষ কবে বৃষ্টি হয়েছিল?" রাজকুমার বললো, "কাল হুই থি বাবু।" আবার প্রশ্ন করল রণজয় "কাল কব? শাম কো?" রাজকুমার বললো, " নাহি দোপেহের। " রণজয় মনে মনে ভাবলো , তাহলে নিশ্চই আজ সারাদিন খুব কড়া রোদ উঠেছিল। এই ভাবতে ভাবতেই জোরে হাওয়া দিতে শুরু করলো। এবার ভেতরটা ছটফট করতে শুরু করল রনজয়ের। নতুন কোন কথা না বলে রণজয় সামনে তাকিয়ে থাকলো। গাড়ির স্পীডটাও যেন এবার একটু বেড়েছে। রাজকুমারও এই জঙ্গলে বৃষ্টির মধ্যে আটকা পড়তে চায়না বোঝা গেল। আর সাথে সাথেই নামলো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি।সাথে ঝোড়ো হাওয়া আর নিকটে বাজ পড়ার শব্দ। "আর কতদূর ভাই রাজকুমার ?" গলা এখন উৎকণ্ঠায় ভরা। বাজ পরে চলেছে একের পর এক। "বাস আগায়ে।"
ঝাঁপসা উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে কিছু আলো দেখতে পেলো রণজয়। কাছাকাছি এসে বুঝলো , ওরা কিছু কোয়ার্টার পেড়োচ্ছে। তারপর আস্তে করে গাড়িটা থামলো। "লি জিয়ে বাবু। পোহছ গেয়ে। "
ড্রাইভারের দরজাটা খুলতেই রণজয় দেখতে পেলো ছাতা সরিয়ে শুভদা মাথা ঢোকাচ্ছে গাড়ির মধ্যে।
"কি রে!" বলে এক গাল হাসল শুভদা। "কি দুর্যোগ নিয়ে এলি রে ভাই! ফোনটা সুইচ অফ কেন? আমি তো রাজকুমারকে কল করিনা রাতে গাড়ি চালালে। উফ চিন্তায় ফেলিস তুই চিরকাল!"
রণজয় নিজের দরজা খুলতে যেতেই বাইরে থেকে রাজকুমার সেটা খুলে দিল। "আর বলিস না! সারা রাস্তা ভাবছি কখন পৌঁছাবো। গা হীম হয়ে এসেছিলো।" রণজয় গাড়ি থেকে বেড় হল। ইতিমধ্যে শুভদা ওর কাছে পৌঁছে গেছে। ওর মাথায় ছাতাটা ধরে বললো, "ডিনার করতে মানে করেছিলাম। খাস নি তো? কষা মাংস আর লুচি আছে। ছোটবেলার মত খাবো চল।" রণজয় হালকা হেসে বললো "একটু খেয়েছি। ক্ষিদে পেয়েছিলো। তাও পেটে জায়গা আছে। " শুভদা হালকা হাসলো, "তুই অপেক্ষা করার ছেলে না আমি জানি। চল এবার দাদার মনা রাখ। "
রাজকুমারের দিকে ফিরে বললো, "তাহলে কাল ১০টায় চলে এস। " রাজকুমার "জি" বলে গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
রণজয় আর কিছু বললো না। দাদার সাথে ঘরে ঢুকে গেল।
স্নান করে খাওয়ার টেবিলে আসলো রণজয়। শুভদা আগে থেকেই বসে ছিল, একটা বৈজ্ঞানিক ম্যাগাজিন পড়ছিলো। রণজয় শুভদার দু কাঁধে হাত রেখে বললো, "তোর বাথরুমটা বেশ বড় তো!" শুভদা হেসে বললো, "হ্যাঁ, এই পশু, পোকা মাকড়ের কিংডমে ঐ একটি মাত্র জায়গা মানব সভ্যতার প্রতীক বলতে পারিস।" তারপর একটু হেসে বললো, "নে, এবার বস। খাওয়া যাক। "
রণজয় শুভদার উল্টো দিকের সিটে বসলো।দেখলো, লুচি, পাঠার মাংস, ছোলার ডাল আর ছানার তরকারি টেবিলে সাজানো। শুভদাকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "এই এতো সব রান্না কি তুই করলি নাকি?" শুভদা হেসে বললো, "তুই কি পাগল? এখানে আমি ছাড়াও তো অন্য মানুষ থাকে। আমায় ইদানিং প্রায় রান্না করতেই হয় না। আমাদের স্যার , উপেনদা, মানে যার বাংলোর কথা তোকে বলেছিলাম, ওনার স্ত্রী-ই এতো কিছু করেছেন।সুচরিতা বৌদি বেড়ে রান্না করেন।খেয়ে দেখ। " রণজয় খেতে শুরু করলো, সাথে শুভদাও। সত্যিই খুব সুস্বাদু। খিদেও পেয়েছিলো রনজয়ের। এমন কিছুই সন্ধ্যে বেলা খায়নি।শুভদাও পারে ! এতদিনেও জানে না যে রণজয় ট্রেনে কিছু খায় না। রণজয় সন্ধেবেলার খাওয়ার কথা বলেছিলো।আর তাতেই শুভদা ওকে কথা শুনিয়ে দিলো।তবে এখন আর সেই সব ভেবে সময় নষ্ট করলো না, জিজ্ঞেস করলো, "ওনারাও কি লুচি খেলেন ডিনারে ?"
"কারা?" শুভদা চোখ ছোট করে তাকালো।
"তোর স্যারের ফ্যামিলি। আবার কারা !"
"ও না না , বৌদি তোর জন্য লুচি করেছেন। আমি বলেছিলাম করতে , তুই পছন্দ ক্রিস তাই। আর মাংসটা আমি কিনে আনলাম সবার জন্য।বলেছিলেন এক সাথে ডিনার করার কথা। কিন্তু আমি না করে দিলাম তোর দেরি হবে বলে। "
"সে ভালোই করেছিস। অচেনা লোকজনের সামনে আমার খেতে অস্বস্তি হয়। "
"আরে ওনারা খুব ভালো।আমায় তো পুরো ফ্যামিলি বানিয়ে নিয়েছেন।আসলে আমি আসার আগে অন্য এক এসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ছিল, কিন্তু সে তেমন মিশতো না নাকি।যাই হোক, সেই গল্প পরে হবে। আসল কথা হলো, আমায় এনারা খুব পছন্দ করেন। ইসি আর ঋতু যতবারই এসেছে, ওনারা ছিলেন না।"
"হুঁ " বললো রণজয়।
"ও হ্যাঁ , ঋতু তো তোকে ফোনে পায়নি।কি যে তোর মতিগতি। এই রাস্তায় সুইচ অফ কেউ করে? সে আমায় ফোন করে খালি জিজ্ঞেস করে তুই পৌছালি কিনা। আমারও টেনশন বাড়ছিল। "
"চার্জ ছিল না। তুই জানিয়ে দিয়েছিস তো ?"
"হ্যাঁ। "
খাওয়া শেষ করে দুজন শুভদার শোয়ার ঘরে যায়। ঘরের এক কোনে একটা টেবিল আর তার সাথে একটা চেয়ার। টেবিলের ওপর বেশ কিছু কাগজ আর বই-এর স্তূপ করা আছে। টেবিলের সোজাসুজি শোয়ার খাট। দরজার ডান পাশেই ড্রেসিং টেবিল। আয়নার কাঁচে ছোট দুটো লাল টিপ লাগানো।ভুঁরু কুঁচকে সেদিকে দেখলো একবার রণজয়। খাটের ওপর একটা ল্যাপটপ, দুটো বালিশ আর দুটো চাদর রাখা আছে। দরজার বাঁ পাশে একটা আলনা , যাতে জামা কাপড় ঝুলছে , তার পাশে একটা মাঝারি সিজি এর আলমাড়ি।টেবিলের পাশের দেওয়ালের মাঝামাঝি কাটা মস্ত এক জানালা।শুভদা খাটে বসে বললো, "কাল সকাল দশটা নাগাদ আমায় একবার সাইটে যেতে হবে। ফেরা সেই রাতে।তুই কি আমার সাথে জাবি? নাকি জঙ্গলটা ঘুরে দেখবি? ড্যামের লাগোয়া একটা ওয়ার্কারদের ছোট্ট গ্রামের মতো আছে। দেখে আস্তে পারিস। ফ্রিজে ভাত, দল আর মাংস থাকবে এমনিও যদি বাড়িতে থাকিস। "
শুভ মাথা নাড়লো, কিছু বললো না। জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বৃষ্টি অনেক্ষন থেমেছে।এই দিকটা পুরোটাই জঙ্গল।ডান দিকের কোনায় অন্য একটা কোয়ার্টার দেখা যাচ্ছে।
শুভদা বললো ,"এই জানালার পূবমুখী। ডান দিকে যেই বাড়িটা দেখতে পাচ্ছিস ওটায় আগের এসিস্টেন্ট ম্যানেজারটা থাকতো।এই জানালা দিয়ে জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। অবশ্য মাঝে সাঝে কিছু শেয়াল দেখা যায়। "
রণজয় সাথে সাথে ফিরে তাকালো।ওর মুখ দেখে শুভদা হাসলো, "আরে ভয়ের কিছু নেই। শেয়াল আর সজারু আছে। এটা প্রটেকটেড এরিয়া। তবে ঘরে কিছু ঢোকেনা।"
রণজয় বললো ,"তুই নাকি সন্ধ্যের পর বাড়ি থেকে বেড়োস না? তোর ড্রাইভার বললো। "
"ব্যাটার খুব মুখ চলে। গাড়ি নিয়ে রাতে আমি বাইরে যাই না। এলাকা তেমনও ভালো না। ড্যামের জন্য ইট , বালি , স্ক্রু , সিমেন্ট কত আমউন্টে আসে বুঝতেই পারছিস। স্মাগলিং-এর ঝামেলা ভালোই আছে এদিকে।রাতে গাড়ি নিয়ে যত কম চলা ফেরা করতে হয় তত ভালো।"
"টর্চ দেখলাম না তো। লোডশেডিং হয় না?"
"কি বলিস রে? ড্যামের পাশে লোডশেডিডিং? মাথা খারাপ হয়েছে নাকি তোর? টর্চ পড়ার টেবিলেই আছে যদিও।"
লোডশেডিং-এর জন্য টর্চের কথা মোটেও তোলেনি রণজয়। একবার টেবিলের দিকে উঁকি মেরে দেখলো , দেওয়ালের পাশে টর্চ রাখা আছে।
শুভদা গায়ে একটা চাদর চাপিয়ে বললো, "তোর কি ঘুমানোর ইচ্ছে নেই?"
রণজয় হেসে বললো, "ট্রেনে ঘুমিয়েছি একটু।"
"প্রেম করছিস?"
একটু হতবাক হয়ে রণজয় শুভদার দিকে তাকালো ,"না। "
"সেটাই ভালো, যতদিন নাম না আসে , ভালো থাকবি।"
শুভদার দিকে তাকালো একবার রণজয়।চাদর ঠিক করতে ব্যস্ত।নিজের মনে একবার হাসলো আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।
"আমার তো কাল বেরোতে হবে ভাই। প্রায় ২টো বাজে।শুয়ে পড়। "
"তুই ঘুমা। আমি একটু টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে পড়ছি, ঠিক আছে। একটা গল্প বেশ ভালো জায়গায় আটকে আছে। "
"অলরাইট ! আমি-রাত্রি "
রণজয় হাসলো শুভদার দিকে তাকিয়ে।তারপর শুভদা শুয়ে পড়লে ও টেবিল লাম্প জ্বালিয়ে ঘরের টিউবলাইট নিভিয়ে দিলো।রনজয়ের উদ্দেশ্য মোটেও গল্পের বই পড়া ছিলনা। ও টর্চটা নিয়ে দেখলো বেশ ভালোই জোড় আছে। তিন ব্যাটারির টর্চ। শুভদার ঘুমের অপেক্ষায় ছিল রণজয়।জানালার সামনে দাঁড়িয়েই ও বুঝেছিলো, এই নীবিড় জঙ্গলের কোলে কোনো অদ্ভুত গল্প বাসা বেঁধে আছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো রনজয়ের। এমন না যে ওর সাহস খুব বেশি।কিন্তু ও যা দেখেছিলো প্রথমবার, তা ওকে বড়ই চঞ্চল করে তুলছিলো।আবার খাটের দিকে তাকালো।শুভদা ঘুমিয়ে পড়েছে।আর সময় নষ্ট করা যায় না।