Thursday, January 13, 2022

ইতিহাসের কাঁটা

তখন আমরা নবম শ্রেণীর ছাত্র। ছোট ছোট বিষয়ে সদ্য পাকতে শুরু করেছি; অনেকটাই সারল্য মেশা থাকে যেই বড় হওয়ায়। লাঞ্চ ব্রেকের পর ইতিহাস শেখার সময়; আল্পনা মিস (আমরা বালুরঘাটের ইংজেরী মিডিয়াম - তাই 'আন্টি' বা 'ম্যাম' বলার অভ্যেস ছিল না) ঢুকলেন ক্লাসে। ঠিক জানিনা কেন, ওনার খুব দাপট ছিল স্কুলে। কিছু মানুষ চলা ফেরা করলে তাদের ওজন সবাই টের পায়, উনি সেই প্রকৃতির মানুষ। আমাদের ক্লাসে বেঞ্চের দুটো সারি থাকতো - একটা দরজার পাশে, অন্যটি জানালার।  জানালার দিকে প্রথম চারটে বেঞ্চে বসতো ক্লাসের মেয়েরা; আর ঠিক তাদের পেছনে শেষের তিন বেঞ্চে যারা বসতো তারা নিজেদের নাম দিয়েছিলো, "NJOY BOYZ"। দরজার দিকের সাতটা বেঞ্চে শুধু ছেলেরাই বসতো; স্বাভাবিক কারণেই তারা নিজেদের কোনো নামকরণ করে ওঠেনি কোনোদিন। 

বর্তমান গল্পের সময়কালে আমি বসেছি দরজার দিকে পেছন থেকে তিন নম্বর বেঞ্চে। আমি বেঞ্চের বাঁ কোনায়, আমার পাশে আমার বাল্যকালের বন্ধু বিপ্রতীম। বিপ্র ছোট থেকেই celebrated একটা ছেলে, বেশ হিরো হিরো ব্যাপার ছিল একটা। ভালো খেলতো, যেমন ওর মাঠ-চেড়া কভার ড্রাইভ তেমনি ওর ডাইভ ক্যাচ; পড়াশোনায় খাঁটি, শরীর চর্চায় আগ্রহী, এবং বান্ধবী-মহলে যথেষ্ট নাম-ডাক থাকা এই ছেলে আবার অসাধারণ ছবি আঁকতো। এরকম সকল-শক্তিমান প্রতিভা সম্পন্ন ছেলে ততোধিক নম্র, ভদ্র চরিত্রেরও অধিকারী ছিল। মানে এক কথায় বলতে হলে, চরম-চালু।তখন স্কুলে বাচ্চাদের ঘড়ি পড়া বারণ ছিল; দেখতে পেলেই "seize" করা হতো। এবার আমাদের হিরো তখন নিজের হিরোইনের চাইতে যে স্কুলের বেখাপ্পা বাজে নিয়মকে কম তোয়াক্কা করবে এটাই স্বাভাবিক; তাই খোকা রোজ ঘড়ি পড়ে আসতো, শুধু তাই না সেই ঘড়ির সে কি কায়দা : একে তো সময় সোজাসুজি পড়ে ফেলা যেত - মাপতে হতো না ঘড়ির কোন হাত কোথায় আছে দেখে ; আবার সাথে আলোও জ্বলতো! সবুজ রঙের ব্যাকলাইট - যা জ্বালিয়ে বাবু বলতেন হাতে রেডিয়াম নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু তা ছাড়াও বিপ্রর সেই কালো বেল্টের ঘড়িতে এক মহামূল্যবান অস্ত্র ছিল, যা সত্যি বলতে সব ঘড়িতেই থাকে।

আগেই বলেছি আল্পনা মিসের দাপটকে আমরা যথেষ্ট সমীহ করেই চলতাম। তাই ঠিক ওনার ক্লাসে আমাদের হিরো নিজের ঘড়ি খুলে ব্যাগে রেখে দিতো। এই দিনও বিপ্র তাই করেছে। তখন আমাদের পোড়ানো হচ্ছে ভারতীয় ইতিহাসের গৌরবের ইতিকথা - অথচ যেন ইতিহাস নিজের কলমে নাম লিখছে সেই ক্লাসের ফার্স্ট এবং সেকেন্ড বয়ের। ওই যে বললাম হিরো - ক্লাসে ফার্স্টও ছিল নবম শ্রেণীতে। এই ক্লাস শুরু হওয়ার ঠিক একটু আগেই আমার মাথায় এসেছে এক আস্ত মতলব! এমনই সেই মতলবের সাফল্যের নেশা যে আমার একদমই হুঁশ নেই ক্লাসে ঠিক কি পড়ানো হচ্ছে! এখন এই বয়সে এসে সেই অবস্থায় নিজের হাবভাব দেখতে ইচ্ছে করে - ঠিক কি এক্সপ্রেশন ছিল আমার ওই মুহূর্তগুলোতে। 

যাই হোক, চুপচাপ কাশীর বেড়াল সেজে বসে আছি, বিপ্র - তথাপি বাকিরা নোট লিখতে ব্যাস্ত। এমন সময় হঠাৎ টি-টি-টি-টিং টি-টি-টি-টিং বেজে উঠতে লাগলো বিপ্রর ব্যাগ। তড়াক করে উঠলো বিপ্রতীম আর আমি কোনো রকম ভাবে নিজের হাসি চাপার চেষ্টা করলাম সমস্ত শরীর দিয়ে  -  এমন ভাবেই যাতে বিপ্র ছাড়া কেউ হাসিটা দেখতে না পায় - ঠিক যেমন অ্যালার্ম-এর শব্দ অন্য কেউ শুনতে পায়নি তখনও। ক্লাস শুরু হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে আমি অ্যালার্ম সেট করে, সাউন্ড মিনিমাইজ করা ঘড়িটা গুঁজে দিয়েছিলাম বিপ্রর ব্যাগের একদম ভেতরে - সব বই খাতার নিচে। যথারীতি আমি আর বিপ্র ছাড়া আর কেউ সেই শব্দ শুনতে পায়নি এবং একই সাথে বিপ্রর ভয়ে চমকে ওঠার ইন্টেন্সিটিও কিছু মাত্র বিসর্জন যায় নি। কোনো প্রকারে দুজন মিলে সেই অ্যালার্ম বন্ধ করে মাথা লুকিয়ে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছি - এর মধ্যে সন্ধ্যা নামলো ভরদুপুরে! 

তীর্থঙ্কর, বিপ্রতীম ? কি হচ্ছে ওখানে? উঠে দাঁড়া তো। 

 ব্যাস! উঠে দাঁড়াবো কি - মাটি সরে গেলে ভালো হয় তখন! চোখ তুলে দেখলাম মিস ততক্ষনে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছেন বিরাট ব্ল্যাকবোর্ড পেছনে ফেলে - আমাদের দিকে! যাদের যাদের killer instinct আছে তাদের আমি শ্রদ্ধা করি - ঈশ্বর আমায় দিয়েছেন শুধুমাত্র survival instinct. সাথে সাথেই ভাবতে শুরু করেছি কি গল্প বানিয়ে বলবো। এর মধ্যেই সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন মিস - "কি পড়াচ্ছি বল তো ?" তাকিয়ে আছেন আমার দিকেই (নিজের এই মুখটাও দেখতে ইচ্ছে করছে এই অকর্মণ্যতার রাতে)। কে জানে কি পড়ানো হচ্ছে! শুনেছি নাকি একটা শব্দও ? প্রথম থেকেই অপেক্ষা করছি নিজের বদ-গিরির রেজাল্টের। এর মধ্যে যত আউট-অফ-সিলেবাস প্রশ্ন! উত্তর পাবেন না দেখে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন বিপ্রতীমের ব্যাটের কাছে। দেখুন, আগেই গুণগান গেয়ে দিয়েছি এই ছেলের ক্রিকেট প্রতিভার - ওরে সালা -  যা আমার জন্য ইয়র্কার তা সুন্দর ফুট-ওয়ার্কের দরুন হয়ে গেল হাফ-ভলি - একদম মিড্ল-অফ-দা-ব্যাট স্ট্রেট ড্রাইভ! বল সাইসাই করে বাউন্ডারি-পার : "Chola-দের trade relations"। এরকম সময় লম্বা ফাস্ট বোলাররা সাংঘাতিক ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে - আমার দিকে ফিরলো জ্বলন্ত দুটি চোখ। থত্থর করে কাঁপতে কাঁপতে ready হওয়ার ব্যবস্থা করছি - বল ছাড়লেন - "হাসছিলি কেন?"

দেখুন মাঠে নেমেছি যখন net practice-এর ওপর আস্থা রেখেই নেমেছি। কিন্তু আমি তো কোর্টনি ওয়ালশ - বলতে শুরু করেছি , "আজ সকালে টিউশন পড়তে গিয়ে দেবযানী মিসের বাড়িতে ঘড়ির অ্যালার্ম ..." 

ঠাস! 

একদম খুলি উড়িয়ে ঘিলু বের করে দেওয়া এক বোম্বাই বাউন্সার! এক চড়েই চমৎকার!

ঠিক যেমন জফ্ফরা আর্চার বা মিচেল জনসন মাটিতে লুটিয়ে পড়া ব্যাটসম্যানের দিকে না তাকিয়ে বোলিং-মার্কে ফিরে যায় - ঠিক তেমনি ভাবে আমার ইজ্জত তখন ক্লাসের মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে, আর আল্পনা ভট্টাচার্য ফিরে গেছেন বোর্ডের কাছে। দর্শক ব্যাটসম্যানকে বেঁচে থাকতে দেখেই যেন নিশ্চিন্ত - মুখ ফিরিয়েছে বোলারের দিকে ততক্ষনে।  গালে হাত রেখেই চুপ করে বসে পড়লাম। 

বিপ্রতীম বললো, "কেন চড় খেলি বলতো?"


******************************** সমাপ্ত **************************************


পুনঃশ্চ : এই প্রশ্নের উত্তরটাও বিপ্রতীমই দিয়েছিলো।  কিন্তু যেহেতু আমি এক-মত নই, তাই আপনার ওপরেই তার দায়ভার ছাড়া থাকলো।

No comments:

Post a Comment

Exodus

What is life but a series of exodi - A child's birth from a safe, nurturing womb A boy learning to walk by himself A young man yearning ...