Friday, January 7, 2022

গুঁড়ি গুঁড়ি স্মৃতি

 মাঝরাত পেরিয়ে রাত্রির গাম্ভীর্য এসে নেমেছে আমার শহরে, লিভিং রুমে। আমার শহর বলতে সত্যি কিছু আছে, নাকি নেই - সে প্রশ্নের যথাযথ উত্তর চট করে আমি দিতে পারবো না। আমার জীবনের প্রথম ১৮ বছর কেটেছে আত্রেয়ী নদীর পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত বালুরঘাটে। আমার ছেলেবেলা, বা বাল্যকাল বলতে যা বোঝায় তার অনেকটা জুড়ে আছে লোডশেডিং, জোৎস্না, ঠাকুমার স্নেহ, আম-কাঁঠাল গাছের স্নিগ্ধ ছায়া, আর স্কুলের পরীক্ষা। তখন বাড়ির ছাদে উঠলে আমাদের উত্তর দিকের প্রাচীর দেখে মনে হতো যেন সমস্ত পাড়া-টাই প্রায় আমাদের; আমি এখনো জানিনা ঠিক কত বিঘা জমির মালিক আমার পরিবারের সদস্যরা , জানতেও চাই না; শুধু ছোটবেলার সেই অবাক হয়ে যাওয়াটা তাৎপর্যপূর্ণ। আমি চিরকালই গন্ডি মেনে চলেছি, স্বাভাবিক চরিত্রে। সব কিছুরই যেন মাপ ছিল বাধা-ধরা। স্কুলের পেছনে দেখতে পেতাম এক অন্য পৃথিবী, সেদিকে যাওয়া যায় না; বাড়ির পেছনে কিছুটা হাঁটলে ভুসলার মাঠ - কি জানি কি রহস্য লুকিয়ে আছে সেখানে; হাটখোলায় শুনেছি মানুষ থাকে, কিন্তু চোখে দেখিনি খুব একটা; বঙ্গিতে চেনা মানুষের বাড়িতে খেলা যায় কিন্তু সেখান থেকেই দেখা যায় বাংলাদেশের বর্ডার - ডাকাতদের ডেরা; এরমই বিভিন্ন প্রান্ত আমার কাছে রোমাঞ্চের জলছবি ছিল সেই কালে। আমার প্রায় সব বন্ধুই আমার আগে আমাদের জন্মের শহরকে চিনেছে, গন্ডি পেরিয়েছে, বড় হয়েছে। অথচ অদ্ভুত ভাবে আমার বাস্তবিক গন্ডি সেই সময়ও ছিল বৃহত্তর - মামাবাড়ি কলকাতায় হওয়ায়। 

তাও আবার কলকাতার বাইরের বরানগরের উত্তর কলকাতা বা নাক উঁচু Southern Avenue নয়; আমার মামাবাড়ি মধ্য-কলকাতার মধ্যমণি : মৌলালী-তে। প্রতি বছরই কম করে দু'বার আমি কলকাতা আসতাম। মামাবাড়িতে ছিল সীমাহীন ভালোবাসা; এখন বড় হয়ে সেই বাড়ি ক্ষয়ে যেতে দেখার পরে বুঝতে পারিনা অত ভালোবাসা কি করে পেলাম ছেলেবেলায়! ছোট মামার (মনু) কাছে আমার ক্লাস 2-এর ছুটিতে দাবা খেলতে ও ঘড়ি দেখতে শেখা ;  দিদার কাছে বারবার শোনা গোপাল ভাঁড়ের গল্প; রাঙা দিদার সর্দির কৌটো খাটের নিচে লুকিয়ে রাখা; ফুল-দাদার সেই খেলনা সাপ দেখে, জেনেও প্রতিবার আমার ভয় পাওয়া, বা প্রথম "তু মেরি কিরণ" বা "বাজিগর ওও বাজিগর" ক্যাসেট শোনা; কোনো এক ভ্যাকসিনের বুস্টার নিয়ে পা ফুলে যাওয়ায় মাসিদের সেই বিছানা অবধি লাল গামলা নিয়ে আসা, রাতের বেলা ৬-৭ জন এক ঘরে ঘুমোনো - জানালা দিয়ে বেড়াল ঢোকা তার মধ্যে - এবং মহানন্দে পরের দিন জানালায় জাল লাগতে দেখা : সবই যেন কালকের গল্প মনে হয়। তবে যে মানুষটার জন্য মামাবাড়ি নামটা স্বার্থক হয়েছে - আমার নসমামা (আমার মেজো মামা; ছোটবেলায় শুনেছি আমার ওনাকে রসমামা ডাকার কথা ছিল, কারণ উনি নাকি খুব রসের মিষ্টি আনতেন)। নসমামার হাত ধরে আমার প্রথম Science City আর Nicco Park যাওয়া, বা মাটির তলায় নাকি ট্রেন চলে- সেই পাতালপুরীর রহস্য দেখতে পাওয়া। MRF স্টিকার লাগানো ব্যাট-টা কিনতে গেছিলাম কলেজ স্ট্রিটে মা আর মপির (penultimate মাসি) সাথে, কিন্তু মনে আছে আবদারটা মিটিয়েছিলেন আমার সেই মেজো মামাই। এছাড়াও মামাবাড়ি যাওয়া মানে ছিল সল্ট লেক যাওয়া - আমার মিষ্টি মাসির বাড়ি। সেখানে থাকতেন মিষ্টি মাসি, মিষ্টি মেসো আর মিষ্টি দিদি। গেলেই মাসি বলতেন, "দীপ শরবত করে দি?" আমি সেটা শোনারই অপেক্ষায় থাকতাম - কাচের গ্লাসে পাওয়া যেত বরফ দেওয়া Orange Squash - অমৃত। শুধু কি আর তাই - মিষ্টি দিদি আমায় একবার Kitkat-এর এক বড় প্যাকেট গিফ্ট করেছিল ক্লাস 4-এ। সেই প্যাকেট বড় অদ্ভুত ছিল; যেন রাংতায় মোড়া Kitkat গুলো সাজানো ছিল সাদা ice tray-তে। বালুরঘাটে তখন Kitkat পাওয়া যেত না আর আমাদের ঘরে রেফ্রিজারেটরও ছিল না। তাই সেই Kitkat-এর প্যাকেট আমি অনেকদিন সামলে রেখেছিলাম। এসব ছাড়াও অসংখ্য স্মৃতি জমে আছে ৯০ দশকের তিলোত্তমার - মামাবাড়ির দুই পাশে দুই অদ্ভুত বাড়ি। একটি লাল রঙের তিনতলা বাড়ি, এবং অন্যটি সাদা দোতলা। সাদা বাড়িটি হলো "বাপ্পা-দার বাড়ি" আর লালটি "বুলা মাসিদের"। সেই লাল বাড়ির ছাদ থেকে হাওড়া ব্রিজ দেখা যেত, এবং বাপ্পা-দার বাড়িতে দেখা যেত আভিজাত্য (এখনই খেয়াল হল বাপ্পাদার নাম আবার অভিজিৎ) এবং ESPN-এ ইন্ডিয়ার খেলা বা Star Sports-এ WWE. আমার ছুটির দিন খুব কমই কেটেছে বালুরঘাটে; তাই পড়াশোনার বাইরের আমার যে বাল্যকালের বড় হওয়া - তার মধ্যে ছিল অসামান্য ঔদার্য। যে সময়ে আমার সব বন্ধুরা ক্রিকেট খেলতে আরেকটু বেশি পারদর্শী হয়ে উঠতো, সেই সময় গুলো আমার কেটেছে মৌলালী, শিয়ালদহ, বেলেঘাটা, কলেজ স্ট্রিট বা শ্যামবাজারে। একবার খুব শখ হল আমার - Globe চাই। পৃথিবীর বুকে মানুষ যে মানচিত্র কেটেছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ জানার ক্ষিদে। মা নিয়ে গেল কলেজ স্ট্রিটে; শুধু Globe-এর জায়াগায় নিয়ে ফিরলাম ATLAS - মন্ত্রমুগ্ধ আমি। মামাবাড়ি ফিরেই সেই বই নিয়ে বসে দেখে নিয়েছি দেশের কোথায় কোথায় এয়ারপোর্ট আছে - সেখানে বালুরঘাটের নাম দেখে তো আমি স্তম্ভিত! বেলেঘাটার C.I.T. বিল্ডিং মোড়ে একটি বিল্ডিঙে থাকতেন আমার বড়দামামা (বড় মামা)। ওনার বাড়িতে গেলেও শরবত অবশ্যম্ভাবী - Rooh Afza; এবং তাতে মেশানো হতো গোলাপ জল। কোনো কালেই আমার সেটা মিষ্টি মাসির বাড়িতে পাওয়া Orange Squash-এর থেকে বেশি ভালো লাগতো না - কিন্তু বড়দামামার বাড়িতে যাওয়ার স্বাক্ষরই ছিল সেই লাল রঙের পানীয়। আর যদি মামা এন্টালি আসতেন, তাহলে আমার জন্য বরাদ্য থাকতো মাখন আর কাজু দেওয়া Good Day বিস্কিটের প্যাকেট। বহুবারই বালুরঘাট ফেরার বাসে মন খারাপ ভুলেছি সেই বিস্কিটে। এখন বুঝি আমাদের ফিরে আসার সন্ধ্যেবেলায় মামা দেখা করতে আসতেন - তাই বাসে আমার সেই বিস্কিট খাওয়া। 

এই সমস্ত ঘটনারই বিবৃতি টানা যায়। বিস্তারিত করা যায় প্রতিটা চরিত্রকে। নতুন বুস্টার নেওয়া হাতে রাত দুটো বেজে যাওয়া আমার বর্তমানের শহরে আর বোধয় জেগে থাকা উচিৎ নয়। এই শহরে রাত্রি নামে বিকেল ৪টের সময়; বৃষ্টি হয় সন্ধ্যে জুড়ে; আলুর চপ বা বেগুনি পাওয়া যায় না কোনো গলির মুখে; সভ্যতার থাম গাঁথা আছে এখানে। কেমব্রিজে বসে নিজের ভবঘুরে জীবন নিয়ে মাঝে সাঝেই তো ভাবি - কিন্তু নিজের ছেলেবেলা নিয়ে তেমন স্মৃতিচারণ করা হয় না। এখন আঁতলামো মেরে জীবনের ডায়ালেক্টিক্স বিশ্লেষণ করতে বসলে মুশকিল। সে পথে হাঁটার সময় আসবে যেদিন, সেদিন হয়তো বসে থাকবো এমন কোনো শহরে যার অস্তিত্ব এখনও আমার কাছে অজানা; যার গন্ধ আমার অচেনা। যেমন একদিন প্যারিস ছিল, অথবা ব্রুসেল্স বা লুভেন , কলকাতা বা চেন্নাই। 

হ্যাঁ, কলকাতাও আমার কাছে অচেনা ছিল। সেই কলকাতা আমার বড় হয়ে ওঠার শহর, নিজেকে চিনতে শেখার আয়না; বিসর্জনের পাণ্ডুলিপি - আজ তার কথা থাক। সারল্য অভিমান করে বুকে জমাট বেঁধেছে অনেক দিন; যদি নিঃস্বাস নিতে চায় কালেভদ্রে, বেঁচে থাক।

No comments:

Post a Comment

Exodus

What is life but a series of exodi - A child's birth from a safe, nurturing womb A boy learning to walk by himself A young man yearning ...