সমাজ শিক্ষার জন্য কার কাছে কৃতজ্ঞ হয় ? শিক্ষাকে আদৌ সামাজিক দাঁড়িপাল্লায় মাপা ঠিক কিনা জানিনা, তবে যে প্রশ্নটি আমার মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে, তার ব্যাপ্তি সামাজিক - কোনো পরিবার বিশেষে সীমাবদ্ধ নয়।
একটি পরিবারের ছেলেমেয়েরা যখন লেখাপড়ায় ভালো হয়, কর্মক্ষেত্রে তাদের সুনাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে, সমাজ তখন সেই মানুষদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে - তাদের idolize করে - এবং যথাযথ সম্মান দেওয়ারও সৎ চেষ্টা করে। কিন্তু এই মানুষগুলোর সাফল্যের অভ্যন্তরে ঠিক কি কারণ লুকিয়ে থাকে তা নিয়ে আমরা অতটা হয়তো ভাবি না।
যেকোনো সাফল্য নিজেই যেমন একটা গল্প হয়, তেমনি সেই সাফল্যের কারণ খুঁজতে গেলে পাওয়া যায় অসংখ্য ব্যর্থতা তথা সাফল্যের ইতিহাস - বেদনার পাণ্ডুলিপি; নিঃস্বার্থ পরিশ্রমের গাথা। এক একটি সফল কাহিনীর পেছনে থাকেন এমন কিছু মানুষ যাঁরা স্বপ্নের গীতিকার; তাঁদের নাম সাফল্যের ঝাঁ চকচকে গায়ে সহজে পড়া যায় না। কোনো সফল ব্যক্তি তাঁদের নিয়ে কথা বললে তবেই তাঁরা মঞ্চ পান।
দশ সন্তানের পরিবারে যখন সবাই লেখাপড়ায় ভালো হয়, তখন তার পেছনে নিশ্চই কেউ সঠিক জোরে সংসারের রাষ্ ধরে থাকেন। যেই মানুষটা এই সংসারকে সামলান, দেখা যেতে পারে তাঁর হয়তো শিক্ষা গ্রহণ করার ইচ্ছে এবং ক্ষমতা দুটোই ছিল প্রবল - আর একই সাথে ছিল সুযোগের মহামারী। অথচ নিজের ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন দিয়েই কিভাবে সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যৎ সাজিয়ে তোলা যায় - এই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের ব্রত। আবার সেই মানুষটার লেখাপড়া না হওয়ায় হয়তো অন্য কোনো মানুষের বুক ভেঙে যায় - সেখানে জন্মের মতো অভিমান বাসা বাঁধে। সদ্য স্বাধীন দেশে পরাধীনতার শেকল মেনে নেওয়া সহজ নয়।
কেউ আবার ২০ জনের সংসারে লেখাপড়া শিখতে চায় - স্বপ্ন দেখে নিজের মতো আত্মসম্মান নিয়ে বড় হওয়ার, এগিয়ে যাওয়ার। কালের কোপে সুযোগ হারিয়ে গেলেও স্বপ্ন থেকে যায়। পরবর্তী প্রজন্ম উত্তরাধিকার সূত্রে সুযোগ এবং স্বপ্ন দুটোই পায় - হয়তো তার বিনিময়ে কিছু সাফল্যও আমদানি হয়।
কেউ শিল্পী হন; প্রতিষ্ঠা পেয়েও যেন তার হাতছানিই অনুভব করে যেতে হয় জীবনভর। তখন নিঃশব্দে নিজের বর্তমান দান করেন পরের প্রজন্মের ভবিষ্যতের ডালায়। উপন্যাস না হয়ে গল্প হওয়া বেছে নিতে পারেন কিছু মানুষ; কেউ বাধ্য হন মেনে নিতে।
আমাদের প্রজন্ম হলো এই সমস্ত ত্যাগের অঙ্কুরিত বীজ। আমরা মেনে নিই না - আমাদের মেনে নিতে শেখানো হয়নি। আমরা মনে করি লড়াই আমাদের চরিত্র। কিন্তু আমরা কি সত্যিই লড়াইয়ের প্রকৃত অর্থ বুঝি? যেই মানুষকে নিজের মাস্টার্স পড়া ছেড়ে বাড়ির ব্যাবসা ধরতে হয়েছিল - আমরা কি তাঁর কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠার গুণগান করি? নাকি নিজেদের দম্ভের ভারে তাঁকে জোচ্চোর ব্যাবসায়ী মনে করি?
আমাদের অসম সমাজ ব্যবস্থায় কেউ যখন শিক্ষা চেয়েও পায় না - তার ব্যথা, তার ক্ষত যে কত গভীর হতে পারে - তা আমার কল্পনার বাইরে। আমরা সাফল্যকে মাথায় তুলে নাচি - ব্যর্থতাকে পারলে আড়ালে পুঁতে রাখি। কিন্তু কেন? ব্যর্থ মানুষের ভীড় ঠেলেই তো তথাকথিত সাফল্যের সম্মুখীন হয়েছি আমরা। আমরা সবাই; শুধু আমার বয়সী সামাজ নয়।
সামাজিক স্তরে আমাদের চিন্তায় এই ব্যর্থ গল্পগুচ্ছ আসন লাভ করুক। আমরা নম্র হই, এই প্রার্থনা করি।
No comments:
Post a Comment