নৌকো চালাতে চালাতেই হাওয়ার ব্যবহার বুঝতে শিখেছিল সুভাষ। ছোট ছোট ঢেউ চেপে হয়তো কোনো একদিন এমন দ্বীপে পৌঁছনোর স্বপ্ন ছিল, যেখানে গুপ্তধন না থাকলেও, তাকে আবিষ্কার করার মহানন্দ লাভ করা যায়। সেই স্বপ্নালু চোখে নোনা বাতাসের ঝাপটা এসে পড়ল এক সন্ধ্যেবেলা। ঝড়। নৌকো উল্টে দেওয়ার ঝড়, ছোটবেলায় শেখা সাঁতারের প্রথম কঠিন পরীক্ষা। অথৈ জল, নিজেকে ভাসিয়ে রাখার লাইফ জ্যাকেট ছাড়া আর কোনো আশ্রয় নেই তখন। কোনো প্রকারে উল্টে যাওয়া নৌকোর সাথেই নিজেকে আঁকড়ে রেখে সেই ঝড়ের রাত কাটিয়ে দিলো সুভাষ। তখন পেট ভর্তি নোনা জল। ভোর হতে দু'বার বমি করে আস্তে আস্তে শরীরে বল ফেরত এলো। সাঁতার ছাড়া গতি নেই।
কিছুটা সাঁতরাতেই সুভাষ বুঝলো সে তীরের দিকে যাচ্ছে। আবার কিছু ক্ষন পাওয়া গেলো জীবনে যখন সমুদ্র শান্ত, পৃথিবী পার্থিব। বেশ কিছু জেলেদের সাথে পরিচয় হলো। যার নৌকা যেমনই হোক, সবাই বলছে তারা নাকি বড় মাছ ধরতে বেরিয়েছে। কেউ কেউ বললো, নৌকায় জায়গা আছে, উঠে পড়তে। উঠে পড়লো একজনের নৌকায়, মাছ ধরতে শেখার নবজাগরিত ইচ্ছে নিয়ে। একদিন, দু'দিন, কিছুদিন যেতে সুভাষের মনে হলো যেন জেলে আক্ষেপ করছে তাকে নৌকোয় নিয়ে; এ ছেলে তো মাছ ধরতেই জানে না! এসব basic skill ছাড়াই আজকাল সব নাবিক হতে চায়! সুভাষ ছোটখাটো একটা মাছ ধরলো একদিন। হাসি মুখে জেলেকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে মাছটি দিয়ে অন্য জেলের নৌকোয় চলে গেলো।
সেখানে মাছ ধরার সাথে জীবনের গান গাইতে শিখলো সুভাষ। এই নৌকোর জেলে একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলো, সে জীবনে কি চায়? সুভাষ বললো, সে শিখতে চায়। জেলে মাথা নেড়ে বললো, সারা জীবন শুধু শিখতে চাইলে তুমি শেখাবে কি করে? জলে থেকেছ এতদিন, সবাই তো এরপরে তোমায় শেখাতে বলবে!
সুভাষ সেদিন জলে নেমেছিল আবার, হয়তো একটু অনিচ্ছার হাত ধরেই। কিন্তু সে বুঝেছিল তাকে নামতে হবেই; সে জীবনের কাছে নিরুপায়। কিছু দূর সাঁতার কাটতেই স্টীমারের হর্ণ তার কানে এসে পৌঁছল। মুখচোরা সুভাষ চোখ তুলে তাকাতে দেখলো, জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন একজন লম্বা সুপুরুষ সৈনিক। স্টীমার সুভাষের দিকেই এগিয়ে এসে তার জন্য জলে দড়ি নামিয়ে দিল। সুভাষ ডেকে উঠে দেখলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে পরীক্ষা করছেন একজন প্রৌঢ়। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন সেই সৈনিক।
প্রৌঢ় বললেন, বলো কোথায় যেতে চাও? বলতে তোমাকেই হবে। সুভাষ ঠিক বুঝে পেলো না কি হচ্ছে! স্টীমার যেখানে যাবে, সেটাই তারও গন্তব্য নয়? এও হয়? সুভাষ মাছ ধরতে যখন শিখছিল, তখন বেশ কিছুবার ভেবেছিল উত্তরের দিকে যেন তীর দেখতে পেতো। সে বললো যে সেই উত্তরের তীরেই সে যেতে চায়। প্রৌঢ় ও সৈনিক বেশি কিছু বললেন না, স্টীমার ঘুরিয়ে দিলেন সেই দিকে। প্রথমবার সমুদ্রে আনন্দ পেলো সুভাষ, স্বেচ্ছায় মাছ ধরলো ক'দিন। তার উৎসাহ দেখে প্রৌঢ় ও সৈনিক তাকে জালও ধার দিলো। এভাবেই একদিন সেই উত্তরের তীরে এসে পৌঁছল স্টীমার। বোঝা গেল, মরুভূমি। ধূ ধূ প্রান্তর; কিছুদূর গিয়ে সুভাষ পেলো একটি ম্যাপ। ফেরত নিয়ে আসলো স্টীমারে। এই ম্যাপ মূল্যবান কিন্তু জলপথে গেলে এর কোনো গুরুত্ব নেই। প্রৌঢ় ও সৈনিক রওনা দিলেন স্টীমারে; আশীর্বাদ করলেন সুভাষকে। বললেন, আবার যেদিন দেখা হবে, সেদিন এই ম্যাপ-এর রহস্য জানতে উদগ্রীব হবেন সুভাষের থেকে। সাথে দিলেন এক মরুদ্যানের খোঁজ। হাসি মুখে বিদায় নিলো সুভাষ।
বেশি দূর চলতে হলো না। মরুদ্যানে পৌঁছে ম্যাপ পাশে রেখে একটু জিরিয়ে নিলো সুভাষ। আহ! কতদিন পর মিষ্টি জল মুখে পেলো। নারকেল গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ কি ঘুমিয়ে নেওয়া যায় না? গুপ্তধনের আশায় সুভাষ ম্যাপ নিয়ে আগ্রহী নয়। সে শুধু তার রহস্য উন্মোচন করতে চায়। কিন্তু সেই কাজ কোনো মতেই সহজ নয়। তাকে শিখতে হবে নতুন ভাষা, নতুন অঙ্ক। আজকের রাতটুকু ঘুমিয়ে নেওয়া যায় না? সে বড় ক্লান্ত। অথচ তার উৎসাহ মনের গভীর থেকে তাকে যেন সতর্ক করে চলেছে। কি অদ্ভুত বিচারের সম্মুখীন আজ সুভাষ, একা, সেই জাহাজের রাতের মত; তফাৎ শুধু এই - যে এখন তার পায়ের নিচে রয়েছে বাস্তবিক মাটি।
খুব ভালো হয়েছে লেখাটি। এক গভীর জীবনবোধের হদিশ পেলাম। আরো লেখা পাবার আশায় থাকলাম ।
ReplyDelete