শীত যেন এই মরশুমে ঢেউ-এ চেপে এসেছে। আজ আছে তো পরশু নেই। তাই মাঘের শুরুতে কোকিলের ডাক আলগা বসন্তের আভাস স্বরূপ শনিবারের দুপুরে ভালোই নিজের জায়গা করে নিয়েছে। আজ সুভাষ বসুর জন্মদিন, তাই কিছু বাড়ির ছাদে তিরঙ্গাও ভাত ঘুম দিচ্ছে মনোরম বিকেল রোদে। আমি মাদুর পেতে তপন রায়চৌধুরীর "বাঙালনামা" খুলে কমলা লেবুর ছাল ছাড়াচ্ছি, আর সামনের বেল, কাঁঠাল, নীম ও কুল গাছে বিবিধ পক্ষীর দিকে নজর রাখছি।
আমি পাখিদের নাম জানিনা, তাদের ডাক চেনা তো দূরের কথা। তাই কোন কোন পাখি আমার ছাদের পাশে সাম্রাজ্য বানিয়েছে তা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি শুধু জানি তারা কেউই কোকিল নয়।
পেছনে দূর থেকে কোকিলের ডাক কানে আসছে। বলাই বাহুল্য, সে ডাকে আচ্ছন্ন করার এক ক্ষমতা আছে। হয়তো এই শব্দ মানেই ছোটবেলার ফাল্গুন-চৈত্রের সুর- যে সুরে পরীক্ষা শেষ হওয়ার গন্ধ ও মামাবাড়ির আদরের ছবি একই সাথে ভেসে আসে। আজ না সেই পরীক্ষা আছে, না মামাবাড়ির আদর। তাই হয়তো বসন্তের সুরও তাল, ছন্দ ভেঙে স্বেচ্ছাতীত সময়ে এসে উপস্থিৎ হয়েছে।
বাঙালনামায় লেখক স্মৃতিচারণ করেছেন কুমিল্লা, বরিশাল, অক্সফোর্ড নিয়ে। আমি কলকাতা, বালুরঘাট, বা কেমব্রিজ নিয়ে ৮0 বছর বয়সে কিছু লিখবো কিনা জানিনা, তবে ৯0 বছরেও যে বাঙালীর চরিত্রে বিন্দুমাত্র ফারাক হয়নি, তা ভালোই বুঝতে পারছি।
আমার বাড়ি থেকে চার-পাঁচ কি. মি. দক্ষিণে গেলেই বাংলাদেশ বর্ডার। পূব কিম্বা পশ্চিমে গেলেও তাই, শুধু উত্তরে স্বাধীন ভারতবর্ষ। তবে দক্ষিণে যেখানে বর্ডার, সেই গ্রামের নাম ডাঙ্গী। সেখানে বিএসএফ ক্যাম্প ছাড়া একটা ছোট ফরেস্টও আছে নদীর গা ঘেঁষে। সেই ফরেস্টেই ২৬ জানুয়ারি আমরা বন্ধুরা গণতন্ত্রের নিদর্শন দিতে লাহরী মাছ ভাজা খাবো, এমনটাই ঠিক করা হয়েছে। ও, সাথে ভাত, মাছের মাথা দিয়ে ডাল, দু ধরণের মাংস, পণীর, ত্রিমহিনীর মিষ্টি দই,ইত্যাদি অনেক কিচুই থাকবে। যদিও আমার সেদিন সাহেবদের সাথে বাড়ি থেকে কাজ করার দিন, তবুও গণতান্ত্রিক বাঙালী-অধিকার তো আর ছাড়া যায় না; সেও তো সাহেবদেরই দান।
মাঝে মাঝে মনে হয়, দেশ বিদেশ ঘুরে আমার মধ্যে কি এলো, আর কি গেল, তার একটা হিসেব করা দরকার। পৃথিবীর বুকে মানুষের যে দাপট, তার কতটা আদৌ আমার মস্তিষ্কে, বুকে বা রন্ধ্রে স্থান পেয়েছে? আর কতটা একটা সাধারণ ঘরের অতি সাধারণ ছেলে এখনও সেখানে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে? এখনও আলমারি খুলে অদ্ভুতুড়ে কান-চাপা টুপি খুঁজে পেলে সেটা পড়েই নির্দ্বিধায় রাস্তায় নামি, অথচ দোতলা বাড়ির মাথায় নতুন করে সিমেন্টের বস্তা দেখতে পেলে মনে মনে আফসোস করি সেই বাড়ির মানুষের প্রতি, কেন সেই টাকা খরচ করে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে না।
আর তখনই প্রশ্ন আসে, কি করলাম আমি ঘুরে বেড়িয়ে? কি দেখলাম? কি জানলাম? উত্তর আসে না এমন নয়। নদীকে সমুদ্রে মিশতে দেখেছি, অন্তহীন পাখির ঝাঁক দেখেছি, Assyria, ইজিপ্ট সভ্যতার অসভ্যতা দেখেছি, মানুষের মুখে মাস্ক উঠতে দেখেছি, তদাপি খসে যেতেও, রাষ্ট্রনীতির উপেক্ষা শুনেছি সেই দেশেরই মানুষের মুখে, রাত নামতে দেখেছি English Channel-এর দু ধারেই মধ্যরাতে, Monet-এর Nympheas দেখেছি মুগ্ধ নয়নে, মাইকেলেঞ্জলোর নিজের হাতে গড়া মূর্তি, ভান-গঘের আঁকা ছবি, বন্ধুরূপী ঈর্ষাকাতর বহুরূপী, ও প্রকৃত বন্ধু সবই দেখেছি।
আর দেখেছি ভালোবাসা। যা দেখার পর, জানার পর, বোঝার পর, এই জীবন স্বার্থক হয়েছে। সারা জীবন এই ছাদে বসে থাকলে শুধু কমলা লেবুর খোসা ছাড়ানোই হতো।