Sunday, June 12, 2022

৩৬৫.২৫

 তখন ক্লাস ১১-এ উঠেছি, তিন মাস ছুটির পরে স্কুল খুলেছে আবার। একদিন খবর পেলাম আমি, কল্যাণ ও ক্লাস ১০-এর ঋদ্ধিকে নিয়ে স্কুল থেকে একটা কুইজ টীম তৈরী করা হয়েছে - Indian Centre for Space Physics থেকে আয়োজিত জাতীয় স্তরে কুইজ কম্পিটিশন; চার ভাগে বিভক্ত - district , zonal, state আর national. বালুরঘাট আদর্শ বিদ্যামন্দিরে written একটা টেস্ট দিয়ে শুরু - প্রথম ধাপ, শহরের সব স্কুল থেকে একটা করে টীম এসেছে। প্রথম তিনটে টীম সিলেক্টেড হবে district level প্রতিযোগিতার জন্য। 

ছোট থেকেই আমার আর কল্যাণের পদার্থ বিদ্যায় তুমূল আগ্রহ, ঋদ্ধিকে সত্যি বলতে তখন চিনতাম না - কিন্তু ওই written টেস্টে বুঝে গেছিলাম আমরা তিনজন বেশ ভালো একটা টীম। আদর্শ বিদ্যালয়, বালুরঘাট গার্লস হাই স্কুল ও আমাদের মধ্যে district level প্রতিযোগিতা হয়। সবই ঠিক মতো এগোচ্ছিল, তবে হতচ্ছাড়া আদর্শের ছেলে গুলো আমাদের পিঠোপিঠি পয়েন্ট স্কোর করছিলো। গার্লস স্কুল কম্পিটিশনের মধ্যে ছিল না। এলো টাই ব্রেকার। একটা প্রশ্ন করা হবে - যারা আগে সঠিক উত্তর দেবে তারা district champion হয়ে zonal রাউন্ডে খেলতে যাবে। প্রশ্নটা ছিল - গড়ে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর কতদিন সময় লাগে? - চারটে option  - ৩৬৫.২৫ , ৩৬৫.৩৬, ৩৬৪, ৩৬৬। সাথে সাথেই কল্যাণ আমার কানে বললো, "চার বছরে একবার লীপ-ইয়ার" - আর সাথে সাথেই আমরা উত্তর দিলাম ৩৬৫.২৫। অবাক কান্ড! সঞ্চালক বললেন উত্তর ভুল - প্রশ্ন গেলো আদর্শের কাছে - তারা বললো ৩৬৫.৩৬ - এবং সভায় ঘোষণা করা হলো, যে আদর্শ district champion.

খুব হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছি দুপুরবেলা। এক ঘন্টার মধ্যে কল্যাণ সাইকেল ছুটিয়ে আমার বাড়ি এসে হাজির - আর সাইকেল থেকে নামার আগেই বলছে - "তিরু, আমাদের উত্তরটা ঠিকই ছিল - এই দ্যাখ।"

কি দেখবো? সেটা কনটেক্সটে আনার জন্য আরেকটু ইনফরমেশন দেওয়া জরুরি। যে তিনটে টীম written exam থেকে সিলেক্টেড হয়েছিল, তাদের প্রত্যেককে কুইজ অর্গানাইজাররা বেশ কিছু বই দিয়েছিলেন astrophysics-এর বিভিন্ন তথ্যের ওপর। তার মধ্যেই একটা বই তখন কল্যাণের হাতে। একটি বাক্য জ্বলজ্বল করছে - সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর গড়ে লাগে ৩৬৫.২৫ দিন। 

হাল ছাড়ার পাত্র আমরা কেউই ছিলাম না। সাথে সাথে যাওয়া হলো ঋদ্ধির বাড়ি। সেখানে ঋদ্ধির বাবা, মা, ভাই -সবাই একটু দুঃখ করেই বসে ছিলেন। আমি আর কল্যাণ প্রবেশ করলাম বুকে, চোখে, মুখে আগুন নিয়ে - আমরা ঠিক উত্তর দিয়েছি - আমাদের ইচ্ছে করে আটকানো হয়েছে! কিন্তু প্রমান কি? প্রমান ছিল অর্গানাইজারদের সাথেই! District level কনটেস্ট পুরোটাই বন্ধ করা হয়েছিল হ্যানডিক্যামে। ব্যাস! সাথে সাথে জানানো হলো আমাদের স্কুলে - তাপস স্যারকে। উনি অবিলম্বে যোগাযোগ করলেন কুইজ অর্গানাইজারদের। ওনাদের প্রথম বক্তব্য ছিল যে আমরা নাকি ভুল উত্তর দিয়েছি। কিন্তু তা বললেই তো আর হয় না - কেউ কেউ অন্যায় মেনে নিতে শেখে না। হ্যানডিক্যামের কথা উঠতেই সুর পাল্টে গেল - পরের দিন খবর এলো আমরাও zonal লেভেলে যাচ্ছি, আদর্শের সাথে। 

Zonal level প্রতিযোগিতা হলো মালদহে। সেখানে ছিলাম আমরা, আদর্শ, ও মালদহের দুটি টীম। যারা জিতবে তারা State level খেলতে কলকাতায় যাবে। কুইজের ফরম্যাটটা হলো এরকম - সব টীমকে directly ১২-টা প্রশ্ন করা হবে - কোনো প্রশ্নই pass করা হবে না - মানে কোনো বোনাস পয়েন্ট নেই। ৪৮-টা প্রশ্ন শেষ হওয়ার পর যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে টাই ব্রেকার, ইত্যাদি। তবে সেই সবের কোনো প্রয়োজন হয়নি - নিজেদের প্রথম ১১-টা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে কুইজ শেষ হওয়ার আগেই আমরা zonal champion হয়ে medal গলায় ঝুলিয়ে নি। লক্ষ্য পরের ধাপ - খেলা হবে। 

স্কুলে তখন টিচাররা আমাদের তিনজনকে নিয়ে খুব খুশি। বাবা-বাছা করে মাথায় তুলে রাখা হচ্ছে। আমি এমনিও স্কুলে সেই আদর-যত্ন ছোট থেকেই পেয়েছি (obedient ছাত্র হওয়ায়) - তবে কল্যাণ তখন স্কুলের হিরো - যেমন বন্ধু মহলে- তেমনি বান্ধবী হৃদয়ে -আর ঠিক ততটাই পপুলার টিচার্স-রুমে। 

মহানন্দে আমরা কলকাতায় আসি। আমার সাথে বাবা-মা, ঋদ্ধির সাথে ওর বাবা, কল্যাণ এসেছে তাপস স্যারের সাথে। সল্ট-লেকের লবন হ্রদ বিদ্যাপীঠে state level কম্পিটিশনে এসেছে ৬-টা স্কুল। মজার বিষয় - বাঁকুড়া থেকে এসেছে সেই বছরের  (২০০৫) মাধ্যমিকে প্রথম স্থানাধিকারী। 

এটা আমার জীবনের প্রথম মঞ্চ নয় - তার আগের বছর স্কুলে টিচার্স ডে-তে উকিলের অভিনয় করতে উঠেছিলাম। তবুও এই মঞ্চ ছিল প্রথম যেখানে নিজেদের ক্ষমতায় পৌঁছেছিলাম। ৬-টি টীম; ৬-টি স্কুল - ১৭টি ছেলে। মুর্শিদাবাদ থেকে যেই স্কুল qualify করেছে - সেখান থেকে এসেছে ২-জন। চশমা পড়া খুব serious তাদের মধ্যে একজন। লটারী করে ৬-টি টীম A থেকে F position-এ গিয়ে বসলো -আমরা হলাম B; Calcutta Boys টীম A.

সেদিনের সঞ্চালক Indian Centre for Space Physics-এর তৎকালীন ডিরেক্টর Prof. সন্দীপ চক্রবর্তী। কুইজের ফরম্যাট বুঝিয়ে দিলেন সবাইকে - ৬-টি টীমকে প্রথমে clockwise (A to F) direct প্রশ্ন করা হবে - সব প্রশ্নে প্রথমে চারটে করে option থাকবে। নিজের direct প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে ৫ পয়েন্ট - ভুল উত্তর দিলে clockwise পরের টীম সুযোগ পাবে ৩ পয়েন্টের জন্য - না পারলে পরের টীম খেলবে ১ পয়েন্ট পেতে। এভাবে একটা রাউন্ড শেষ হবে। তারপর দ্বিতীয় রাউন্ড হবে anticlockwise (F to A). তারপর প্রয়োজন মতো টাই-ব্রেকার। 

শুরু হলো Calcutta Boys-কে দিয়ে। প্রথম প্রশ্ন; ৫ পয়েন্ট , ভুল উত্তর! আমরা সাথে সাথে উত্তেজিত - হাতের মুঠোয় ফ্রীতে ৩ পয়েন্ট আসতে চলেছে। কিন্তু তার আগেই উত্তরটা দিয়ে বসলেন সঞ্চালক মহাশয় নিজেই! সমস্ত অডিটোরিয়াম এক সাথে অবাক নিঃস্বাস ত্যাগ করলো! গন্ডগোল করে ফেলেছেন কলকাতা চত্বরের তৎকালীন বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্বয়ং! এবার কি হয়! সাথে সাথেই decision নিলেন Prof. চক্রবর্তী - নতুন করে শুরু হবে খেলা। ও, বলে রাখি - প্রতিটা প্রশ্নই একটিভ থাকা কালীন স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছিলো। যাই হোক, সবার এখন এই debacle ভুলে গিয়ে নতুন করে খেলায় মন দেওয়ার পালা! উনি আবার প্রশ্ন করলেন Calcutta Boys-কেই। Direct প্রশ্ন - ৫ পয়েন্ট - এবার ঠিক উত্তর দিলো Calcutta Boys. পরের প্রশ্ন এলো আমাদের কাছে (৫ পয়েন্ট)- আমরা দিলাম ভুল উত্তর। খেলা গিয়ে দাঁড়ালো - Calcutta Boys আমাদের থেকে ৮ পয়েন্ট পিছিয়ে না থেকে, ৫ পয়েন্টের লিড নিয়ে খেলা শুরু করলো। যখন clockwise প্রথম রাউন্ড শেষ হলো - আমাদের সংগ্রহে তখন মোটে ৫ পয়েন্ট। সবার থেকে এগিয়ে রয়েছে মুর্শিদাবাদের চশমা পড়া সুলতান; আমরা ষষ্ঠম স্থানাধিকারী (সঠিক সঞ্চালন হতো এটা - Restart-এর প্রথম প্রশ্ন করা উচিৎ ছিল আমাদের -৩ পয়েন্টের জন্য; এবং তার পরের প্রশ্নটাও আমাদেরই ৫ পয়েন্টের)।

শুরু হলো anticlockwise রাউন্ড। খেলা দেখলো অডিটোরিয়াম। শেষ হলো দ্বিতীয় রাউন্ড। এখন আমাদের স্কোর ২৬ পয়েন্ট। কলকাতা জয় করেছেন সিরাজ - ৪১ পয়েন্ট। কিন্তু খেলা তো শেষ নয়! শেষ পংক্তিতে নিজেদের স্বাক্ষর রেখে যাওয়ার ট্রেডিশন আমরা তখনও ধরে রেখেছি। যুগ্ম-তৃতীয় হয়ে বসে আছি, সেই Calcutta Boys-এর সাথে। আবার টাই ব্রেকার - এক টাই ব্রেকার দিয়ে জীবনের এই চ্যাপ্টারের prologue লেখা; অতএব এটাই যথাযত যে আরেক টাই ব্রেকার দিয়ে সজ্জিত হবে উপসংহার। 

সন্দীপ চক্রবর্তীর কম্পিউটারে তখন চারটে প্রশ্ন বাকি। Sudden death খেলা - দুটি টীমকেই প্রথমে একটি করে direct প্রশ্ন করা হবে - কে আগে বেশি পয়েন্ট স্কোর করবে? প্রথম রাউন্ডটা হবে clockwise - যদি Calcutta Boys ভুল উত্তর দেয় - আমরা pass-এ ঠিক উত্তর দিলে খেলা শেষ; অথবা যদি তারা ঠিক উত্তর দেয় ও আমরা আমাদের direct প্রশ্নে ভুল - তবেও খেলা শেষ।

কিন্তু খেলা শেষ হলো না - দুটো টীম-ই নিজেদের প্রশ্নের ঠিক উত্তর দিলো। এবার হাতে বাকি দুটো প্রশ্ন। Anticlockwise. এই দুই প্রশ্নেও একই ফলাফল হলে কী হবে -তা তখনও অজানা! যদিও সেখানে জল গড়ালো না। আমরা দিলাম ভুল উত্তর - Calcutta Boys pass-এ তৃতীয়। 

পুরস্কার স্বরূপ সিরাজ-উদ-দৌলাহের হাতে Prof. U. R. Rao তুলে দিলেন GSLV-এর 1/10th size-এর replica. State Level-এ দ্বিতীয় স্থানাধিকারীদের জন্য 1/20th GSLV, Calcutta Boys পেলো 1/50th - আর আমরা 1/100th উচ্চতার একটা গোল্ড-প্লেটেড replica - যা এখনও আমাদের স্কুলের প্রিন্সিপাল অফিসের ডেস্কে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। 

আজ হঠাৎ এই গল্পের কারণ কি? আমার অনেক স্মৃতি-চারণেই নিজের আক্ষেপের কথা লেখা থাকে; ভুলের বর্ণনা; আফসোসের দলিল হয়ে ওঠে আমার শব্দ-ভান্ডার। কিন্তু শুধু নেগেটিভকে আঁকড়ে ধরে থাকার বান্দা তো আমি নই। চার বছরে একবার পৃথিবী নিজের অস্তিত্বের হিসেব বুঝে নেয় - বুঝে নিতে হয় সমাজের সমস্ত জীবকে। 

থেমে যাওয়া, হেরে যাওয়া, মেনে নেওয়া - সেরকমই periodically কেউ কেউ ধুয়ে ফেলে। কালের নিয়মে। প্রকৃতির নিয়মে। যারা ৩৬৫-এর গায়ে লেগে থাকা .২৫-কে বোঝে না, তারা অঙ্ক বোঝে না; বা রাতের আঁধারে তারাদের মূল্য বোঝার চেষ্টা করে না। কিন্তু এই মহাবিশ্ব কারোর বোঝার ধার ধারে না - সত্যকে অবলম্বন করে নিজের ভবিষ্যতে এগিয়ে যায় - সে সত্য আলোয় ভরা হোক বা গভীর নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে। কারোর চোখে এই পথ চলা arrogance, কারোর চোখে শুধুই অন্ধকারের হাতছানি - কেউ কেউ দ্যাখে আলোর স্বপ্ন; কিন্তু সময় নির্বিকার। তার চরিত্র অগ্রমুখী।

আমরা national level-এ qualify করিনি। State level-এও প্রথম রাউন্ডে সেরকম ভালো পারফর্ম করিনি। কিন্তু অ্যাডাল্ট হওয়ার আগেই নিজেদের অধিকারের জন্য সঠিক লড়াই করেছি - এবং বৃহৎ মঞ্চে ওঠার আগে জীবনের ক্ষুদ্র মঞ্চের দর্শকদের entertain করেছি। Shakespeare নিশ্চই বলেছেন, "All the world’s a stage, And all the men and women merely players" - ধ্রুব সত্য - শুধু নিজেদের চরিত্র সেদিন নিজেরা লিখেছিলাম। 

কলমের নিবে আত্মবিশ্বাস আজও মুখিয়ে আছে।

No comments:

Post a Comment

বন্ধু

 ভোর-রাতে, নিঃশব্দে সময় এসেছিল পাশে  জীবনের কিছু ক্ষণ নিয়ে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে । হাতে হাত, পুরোনো দুই বন্ধুর দেখা বহুদিন পর; হঠাৎ করেই খুঁজে...