শীতের সকাল। মাফলার চাপা মুখগুলো মল্লিক ঘাটে ফুল সংগ্রহে ব্যাস্ত। ভোরের জোয়ারে গঙ্গা উপচে পড়ছে যেন আজ। পাশের আখড়ায় নিয়মিক কুস্তি বর্তমান। স্মার্টফোন ও ক্যামেরা হাতে কিছু পঁচিশ -ত্রিশ বছরের যুবক ঠান্ডা উপেক্ষা করে তিলোত্তমাকে বন্দী করতে উদ্যত। কুয়াশা ভরা মানচিত্রে এখনো জলে হলদে আভার দেখা নেই। সেই কুয়াশা ভেদ করেই মাথা উঁচু করে উঁকি দিচ্ছে হাওড়া ব্রিজ , যেন সকাল সকাল নিজের ঘরবাড়ি সার্ভে করে নিচ্ছে বুড়ো।মল্লিক ঘাট ও ফুলের বাজার জোড়া লাগে কিছু অন্ধকূপ গলি দিয়ে।এই গলি গুলো খুব বেশি হলে দশ থেকে পনেরো মিটার লম্বায় ও দুই মানুষ চওড়া। গঙ্গা স্নান সেরে আত্মারাম সূর্য প্রণাম করলো।তার পরনে শুধুই একটা লাল সাদা খোপ কাটা গামছা।প্রণামের পর রাতের বসন নদীতে ধুয়ে নিংড়ে নিলো আত্মারাম।তারপর হাত লাগলো ফুলের বাজারের দিকে।ঘাটের নোংরা এড়িয়ে গলি তে লাফ দিয়ে ঢুকলো।আর ছ-সাত পা হাঁটলেই পরিষ্কার ফুলের বাজার।স্বস্তিতে দু পা এগোতেই সামনে এক দীর্ঘ দেহ এসে দাঁড়ালো। মুখের দিকে না তাকিয়ে আত্মারাম এগোনোর চেষ্টা করতেই সে বুঝলো তার রাস্তা রোধ করতেই এই মানুষ টি এসেছে।রাগে ও বিরক্তিতে আত্মারাম সেই মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যেতেই পেতে চিনচিন করে ব্যাথা বাড়তে শুরু করলো।হঠাৎ-ই চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। নিজের পায়ের জোর হারানো বুঝতে পারলো।আর কিছুই সে বুঝলো না। নিথর দেহটা লুটিয়ে পড়লো জল, আলো, ফুল ও মাটির অদ্ভুৎ এই সঙ্গমস্থলে। সব কিছুই হল কয়েক সেকেন্ড-এ। কলকাতাবাসী একটু পরে টের পাবে এক নামজাদা ব্যবসায়ী তোলার টাকা দিতে নারাজ হওয়ায় দিনে দুপুরে নির্মম ভাবে খুন হয়ে গেলো।নীরাজ সরু ছুরিটা নিজের জ্যাকেট এ ঢুকিয়ে ঘাটের দিকে হাঁটলো। তারপর পাশের গলি ধরে আবার ফুলের বাজারেই ফেরত এলো। ইতিমধ্যে হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে।নীরাজ বাঁ দিকে ফিরে সোজা হেঁটে ব্রিজের সিঁড়িতে পৌছালো।দেরি না করে হাওড়া ব্রিজে উঠে পড়লো সে। কিছু পুলিশ কে দ্রুত নিচে নামতে দেখলো। লোক জমতে সরু করেছে ব্রিজের ওপরেও। সেই দেখে গাড়ি গুলোও বেগ কমিয়ে দিয়েছে।সে দ্রুত হাঁটা লাগলো হাওড়া স্টেশনের দিকে। বাঁ দিকে দেখলো কুয়াশা কেটে সূর্য দেখা দিয়েছে। স্টেশনে ঢুকে লোকাল ট্রেনে উঠে পড়লো নীরাজ। টিকেট সে আগেই কেটে রেখেছিলো। ট্রেন ছাড়ার সাথে সাথে sms করলো তাকে দেওয়া নম্বরে।
"খাঁচাছাড়া "
তারপর একটা জানালা ধরে সে বসে পড়লো।চোখ বন্ধ করে জ্যাকেটের হুডটা মাথায় চাপিয়ে নিলো।
চন্দননগরে নেমেই একটা সিগারেট ধরালো নীরাজ। স্টেশনের সামনেই সাইকেল রাখার দোকান।নিজের সাইকেল নিয়ে সে পারি দিলো। GT রোড পেরিয়ে সে গিয়ে উঠলো গঙ্গাপারে। ডুপ্লে কলেজের পাশে চন্দননগর মিউজিয়াম। সাইকেল ভেতরে পার্ক করে সামনের হ্যান্ডপাম্পে নিজের রুমাল তা ধুয়ে নিলো। তারপর সে উঠে পড়লো দোতলায়। ডান দিকের শেষ ঘরে ঢুকলো নীরাজ। ঘরে সাজানো রয়েছে ৫০০-১০০০ বছরের দুষ্প্রাপ্য বন্দুক, তলোয়ার। প্রায় সব কোটাই জং ধরে নিজের পুরাতন হওয়ার প্রমান দিচ্ছে। নীরাজ সোজা গিয়ে জানালার পাশে রাখা কাঁচের বাক্সর কভারটা খুললো। জ্যাকেটের ভেতর থেকে ছুরিটা বের করে রুমালে মুছে নিলো। তারপর সেটিকে ওই বাক্সে রেখে আবার বন্ধ করে দিলো। বাঁ দিকের দরজা দিয়ে সে গিয়ে উঠলো কালেক্টর সাহেবের ঘরে। এই ঘরের তিন দিকে দরজা। মাঝে এক বিরাট পালংক। তার ওপরে তিন ব্লেডের অতি পুরাতন এক পাখা।মাথার বালিশের ওপর কবিগুরুর ছবি। ফরাসি চন্দননগরের কালেক্টর সাহেবের বাড়ি তথা কাছারি এখন পপরিণত হয়েছে মিউজিয়ামে।এই ঘরের পশ্চিম মুখী দরজার পাশে একটি ছোট্ট বেসিন ক-দিন আগে জোড়া হয়েছে। রুমালটা ভালো করে ধুয়ে নিলো নীরাজ। রক্তের দাগ এখনো আছে বৈকি। কিন্তু এই নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছে নেই এখন নীরাজের। সে ঘরের দুটো দরজা বাইরে দিয়ে বন্ধ করলো। তারপর দক্ষিণের দরজা দিয়ে ঢুকে সেটাও ভেতর দিয়ে বন্ধ করে দিলো। পাখা চালিয়ে সে উঠে পড়লো খাটে। জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা ছোট্ট সুগার কিউব বের করলো নীরাজ। আঁঙ্গুলের ফাঁকে এক দুবার ঘুরিয়ে মুখে পুড়ে নিলো। তারপর গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। চোখ বুজে অপেক্ষা করলো ...
জানালার ফাঁক দিয়ে একটা সরু এল ঘরে ঢুকছে। তারপর ভাঙছে ; নীল , সবুজ, লাল, হলুদ, বেগুনি, সবুজ ,লাল, কমলা। গুড়ো গুড়ো নীল যেন ভেঙে পড়ছে সেখান থেকে। ওপরের পাখা গুলো যেন ঘুরছে না। কিন্তু ঘুরছে। ভাঙা নীল রং গুলো গিয়ে ওই পাখায় গিয়ে মিশে যাচ্ছে। নীল পাখা গুলো নিজের খেয়ালে ঘুরছে। ডান পাশের দরজা দিয়ে আলোর ছটা লাল আর হলুদ বলে পরিণত হয়ে লুডোর গুটির মতো দেখাচ্ছে। খাটের পাশে রাখা জলের গেলাসের দিকে হাত বাড়াতেই সেটা যেন তরল হয়ে যাচ্ছে ; হাতে গোলে যাওয়ার মতো। এবার নিজেই সে ভেসে উঠছে কিন্তু একি ! আর একটু হলেই তো পাখার ব্লেডে কাটা পরবে সে। কিন্তু থামছে না কোনো। সে তো উঠেই চলেছে। ডান হাত একটু নাড়াতেই যেন সাঁতারের ইঙ্গিত পেলো নীরাজ। দু হাত নিজে থেকেই ভাসতে থাকলো তাকে ,সেই সদর রং গুলো একে একে এসে তার গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে , যেন সমুদ্রের ঢেউ। শুধু রঙীন সমুদ্র। এক একটা ঢেউ এক এক রঙের। দূরে দিগন্তে এল কমে আসছে, সূর্য ডুবে যাচ্ছে? এখনই? সমুদ্রের রং? একি, সব রং-ই তাকে ছেড়ে যাচ্ছে হঠাৎ। কালো, কালো, কালো, কালো মাকড়শা। হাজার হাজার হাত তাকে জাপ্টে ধরছে। তার মধ্যে ঢুকে তার শিরায় বিষ ঢেলে চলেছে শুধু। কিন্তু ব্যাথা নেই কেন? আরাম। ঠান্ডা , কালো, রাত। মরুভূমি। দূর থেকে ভেসে আসছে অট্টহাসির আওয়াজ। কিন্তু কোন দূর? চারিদিকে অন্ধকার। আকাশ নেই, তারা নেই, চাঁদ নেই। অন্ধকার, অট্টহাসি। পায়ে সবুজ এক গাছ জড়িয়ে যাচ্ছে। তাকে টানছে বালির ভেতর। কথ্য বালি? সব-ই তো অন্ধকার।এই সবুজ কোথায় ছিল?আবার সেই মাকড়শা। এবার সাদা। হাওয়ায় তার হাত গুলো উড়ছে। ওপরে দুটো চোখ। এই চোখ তো চেনা। "ও তুমি? কবিগুরু? তুমি কি করছো আঁধারে? এই চোখ খোলা কেন? আমি তো বুজে দিয়ে এলাম সকালে! কে তুই? আত্মারাম? শুওরের বাচ্চা টাকা তা দিতে কি হতো তোর? ওরা মারিয়েছে, আমার কাছে কি করছিস? এ কি হাওয়া? জোরে হাওয়া কেন? আরে কেউ দে ,জানালাটা দিয়ে দে। এই হাওয়া ঠান্ডা, খুব ঠান্ডা। আমার কবিতায় তো ও ছিল। ওর চোখ ছিল, ওর মূর্তি ছিল। গঙ্গার ধারে সেই হাত ধরেছিলাম, ঠান্ডা। নিষ্ঠুর। শান্ত কেন সব? কে কোথায় আছো?" পাখা যেন হঠাৎ-ই জোরে ঘুরতে শুরু করেছে আবার। রং কোথায়? নেই। সব অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ব্লেড গুলোও আর নীল নেই। মোমটা আবার জ্বলছে। শিখা আকাশের দিকে উঠছে ; শুরু, লম্বা ছুরি।
"খাঁচাছাড়া "
তারপর একটা জানালা ধরে সে বসে পড়লো।চোখ বন্ধ করে জ্যাকেটের হুডটা মাথায় চাপিয়ে নিলো।
চন্দননগরে নেমেই একটা সিগারেট ধরালো নীরাজ। স্টেশনের সামনেই সাইকেল রাখার দোকান।নিজের সাইকেল নিয়ে সে পারি দিলো। GT রোড পেরিয়ে সে গিয়ে উঠলো গঙ্গাপারে। ডুপ্লে কলেজের পাশে চন্দননগর মিউজিয়াম। সাইকেল ভেতরে পার্ক করে সামনের হ্যান্ডপাম্পে নিজের রুমাল তা ধুয়ে নিলো। তারপর সে উঠে পড়লো দোতলায়। ডান দিকের শেষ ঘরে ঢুকলো নীরাজ। ঘরে সাজানো রয়েছে ৫০০-১০০০ বছরের দুষ্প্রাপ্য বন্দুক, তলোয়ার। প্রায় সব কোটাই জং ধরে নিজের পুরাতন হওয়ার প্রমান দিচ্ছে। নীরাজ সোজা গিয়ে জানালার পাশে রাখা কাঁচের বাক্সর কভারটা খুললো। জ্যাকেটের ভেতর থেকে ছুরিটা বের করে রুমালে মুছে নিলো। তারপর সেটিকে ওই বাক্সে রেখে আবার বন্ধ করে দিলো। বাঁ দিকের দরজা দিয়ে সে গিয়ে উঠলো কালেক্টর সাহেবের ঘরে। এই ঘরের তিন দিকে দরজা। মাঝে এক বিরাট পালংক। তার ওপরে তিন ব্লেডের অতি পুরাতন এক পাখা।মাথার বালিশের ওপর কবিগুরুর ছবি। ফরাসি চন্দননগরের কালেক্টর সাহেবের বাড়ি তথা কাছারি এখন পপরিণত হয়েছে মিউজিয়ামে।এই ঘরের পশ্চিম মুখী দরজার পাশে একটি ছোট্ট বেসিন ক-দিন আগে জোড়া হয়েছে। রুমালটা ভালো করে ধুয়ে নিলো নীরাজ। রক্তের দাগ এখনো আছে বৈকি। কিন্তু এই নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছে নেই এখন নীরাজের। সে ঘরের দুটো দরজা বাইরে দিয়ে বন্ধ করলো। তারপর দক্ষিণের দরজা দিয়ে ঢুকে সেটাও ভেতর দিয়ে বন্ধ করে দিলো। পাখা চালিয়ে সে উঠে পড়লো খাটে। জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা ছোট্ট সুগার কিউব বের করলো নীরাজ। আঁঙ্গুলের ফাঁকে এক দুবার ঘুরিয়ে মুখে পুড়ে নিলো। তারপর গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। চোখ বুজে অপেক্ষা করলো ...
জানালার ফাঁক দিয়ে একটা সরু এল ঘরে ঢুকছে। তারপর ভাঙছে ; নীল , সবুজ, লাল, হলুদ, বেগুনি, সবুজ ,লাল, কমলা। গুড়ো গুড়ো নীল যেন ভেঙে পড়ছে সেখান থেকে। ওপরের পাখা গুলো যেন ঘুরছে না। কিন্তু ঘুরছে। ভাঙা নীল রং গুলো গিয়ে ওই পাখায় গিয়ে মিশে যাচ্ছে। নীল পাখা গুলো নিজের খেয়ালে ঘুরছে। ডান পাশের দরজা দিয়ে আলোর ছটা লাল আর হলুদ বলে পরিণত হয়ে লুডোর গুটির মতো দেখাচ্ছে। খাটের পাশে রাখা জলের গেলাসের দিকে হাত বাড়াতেই সেটা যেন তরল হয়ে যাচ্ছে ; হাতে গোলে যাওয়ার মতো। এবার নিজেই সে ভেসে উঠছে কিন্তু একি ! আর একটু হলেই তো পাখার ব্লেডে কাটা পরবে সে। কিন্তু থামছে না কোনো। সে তো উঠেই চলেছে। ডান হাত একটু নাড়াতেই যেন সাঁতারের ইঙ্গিত পেলো নীরাজ। দু হাত নিজে থেকেই ভাসতে থাকলো তাকে ,সেই সদর রং গুলো একে একে এসে তার গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে , যেন সমুদ্রের ঢেউ। শুধু রঙীন সমুদ্র। এক একটা ঢেউ এক এক রঙের। দূরে দিগন্তে এল কমে আসছে, সূর্য ডুবে যাচ্ছে? এখনই? সমুদ্রের রং? একি, সব রং-ই তাকে ছেড়ে যাচ্ছে হঠাৎ। কালো, কালো, কালো, কালো মাকড়শা। হাজার হাজার হাত তাকে জাপ্টে ধরছে। তার মধ্যে ঢুকে তার শিরায় বিষ ঢেলে চলেছে শুধু। কিন্তু ব্যাথা নেই কেন? আরাম। ঠান্ডা , কালো, রাত। মরুভূমি। দূর থেকে ভেসে আসছে অট্টহাসির আওয়াজ। কিন্তু কোন দূর? চারিদিকে অন্ধকার। আকাশ নেই, তারা নেই, চাঁদ নেই। অন্ধকার, অট্টহাসি। পায়ে সবুজ এক গাছ জড়িয়ে যাচ্ছে। তাকে টানছে বালির ভেতর। কথ্য বালি? সব-ই তো অন্ধকার।এই সবুজ কোথায় ছিল?আবার সেই মাকড়শা। এবার সাদা। হাওয়ায় তার হাত গুলো উড়ছে। ওপরে দুটো চোখ। এই চোখ তো চেনা। "ও তুমি? কবিগুরু? তুমি কি করছো আঁধারে? এই চোখ খোলা কেন? আমি তো বুজে দিয়ে এলাম সকালে! কে তুই? আত্মারাম? শুওরের বাচ্চা টাকা তা দিতে কি হতো তোর? ওরা মারিয়েছে, আমার কাছে কি করছিস? এ কি হাওয়া? জোরে হাওয়া কেন? আরে কেউ দে ,জানালাটা দিয়ে দে। এই হাওয়া ঠান্ডা, খুব ঠান্ডা। আমার কবিতায় তো ও ছিল। ওর চোখ ছিল, ওর মূর্তি ছিল। গঙ্গার ধারে সেই হাত ধরেছিলাম, ঠান্ডা। নিষ্ঠুর। শান্ত কেন সব? কে কোথায় আছো?" পাখা যেন হঠাৎ-ই জোরে ঘুরতে শুরু করেছে আবার। রং কোথায়? নেই। সব অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ব্লেড গুলোও আর নীল নেই। মোমটা আবার জ্বলছে। শিখা আকাশের দিকে উঠছে ; শুরু, লম্বা ছুরি।